1. admin@ichchashakti.com : admin :
রবিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ০২:৪১ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
কুড়িগ্রামের লেখিকা নিপা’র কিছু কবিতাংশ “স্বপ্নের ছোঁয়া সাহিত্য পুরস্কার-২০২৫” এ শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জিতলো ‘চা জগত’ – বই  সাহিত্য আড্ডা ও সাফারি পার্ক ভ্রমণ ২০২৫ ইচ্ছাশক্তি সাহিত্য পরিবার আয়োজিত সাহিত্য আড্ডা ও সাফারি পার্ক ভ্রমণ ২০২৫ ইচ্ছাশক্তি সাহিত্য পরিবারের অনুষ্ঠান রৌমার, কুড়িগ্রাম -এর নবীন লেখিকা নিপা’র দুইটি কবিতা অর্ধ নারীশ্বর —– প্রীতম ভট্টাচার্য শেষ যাত্রা —- প্রীতম ভট্টাচার্য অর্পিতা সাহিত্য লাইব্রেরী-এ.এস.এল এর প্রাথমিকভাবে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন যাঁরা… ক্যান্সারে আক্রান্ত মাও. এনামুল হাসান ফারুকীর পাশে দাঁড়ালো আল ইরশাদ ফাউন্ডেশন –

শৈশবের ঈদ আনন্দ — মাসুদ রানা 

  • প্রকাশের সময় : বুধবার, ৪ জুন, ২০২৫
  • ৮৬ বার প্রতিবেদনটি দেখা হয়েছে
আমাদের গ্রাম জলিল সরদার পাড়া, রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ থানার এক শান্ত-স্নিগ্ধ ছোট্ট গাঁ। চারদিকে গাছপালা, লতাপাতা, পাখির ডাক আর নদীর কলকল শব্দে ভরা। মনে হয় যেন প্রকৃতি আপন করে আগলে রেখেছে এই গ্রামটাকে। শহরের ধুলোবালি আর যান্ত্রিক কোলাহল থেকে অনেক দূরে, এই পাড়ায় শৈশব কেটেছে আমার, আর সেই শৈশবের ঈদ মানেই ছিল এক রঙিন স্বপ্নের জগৎ।
ঈদের আগে প্রস্তুতির আনন্দ
ঈদের কয়েকদিন আগে থেকেই গ্রামের একটা উৎসবমুখর পরিবেশ শুরু হইতো। বাড়ির বড়রা যেমন কোরবানির গরু কেনার চিন্তায় ব্যস্ত, তেমনি আমরা ছোটরা ব্যস্ত থাকতাম ঈদের জামা-জুতা পাওয়ার আশায়। মা ঈদের আগের রাত থেকেই মচমচে সেমাই, পোলাওয়ের চাল, গরুর মাংসের খাসি রান্নার প্ল্যান করত।
গরু কিনতে যাইতো আমার বাবা আর বড় ভাইরা। দূরের হাটে যাইতো – মাঝেমাঝে রাজবাড়ী কিংবা দৌলতদিয়া হাটে। আমরা ছেলেমেয়েরা অধীর আগ্রহে বসে থাকতাম কবে গরুটা আসবে। গরু আসলে পাড়ার সবাই ছুটে আসত দেখতে, “এই যে দেখো জলিল সরদারের গরু!”—এই বলে সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখত। কেউ কেউ হাত বুলিয়ে বলত, “ভালোই গরু হইছে, খাসি টানাটানি করবো নাকি?”
চাঁদ দেখা আর ঈদের আগের রাত
ঈদের চাঁদ দেখার আলাদা একটা মজা ছিল। কেউ বাঁশের মাচায় উঠে, কেউ তালগাছের ডগায়, কেউ আবার কাঁচার ছাদে উঠে চাঁদের খোঁজ করত। যখন কেউ চিৎকার করে বলত “চাঁদ উঠছে! চাঁদ উঠছে!” তখন পুরো পাড়া জেগে উঠত আনন্দে। মসজিদে মাইকে ঘোষণা হইত, “আগামীকাল ঈদুল আযহা ইনশাআল্লাহ।”
ঈদের আগের রাতটা ছিল সোনার চেয়েও দামী। মা বোনেরা চুলে মেহেদি লাগাইতো, পিঠাপুলি বানাতো। আমরা ছোটরা নতুন জামা বার বার পড়ে আয়নায় দেখে আবার খুলে রাখতাম। ঘুম আসত না, কারণ পরদিন ঈদ! ঘরে এক অদ্ভুত খুশির সুবাস ভেসে বেড়াত।
ঈদের সকাল
ভোরবেলা মসজিদের আজান শুনেই উঠে পড়তাম। ঘুম চোখে ঈদের নতুন জামা পড়তাম। মা বলত, “আগে গোসল করো, তারপর নামাজে যাইও।” পুকুরঘাটে কাঁপতে কাঁপতে গোসল করে উঠতাম, আর মনে হইত, এ যেন এক তাজা বাতাসে ভরা পবিত্রতা। এরপর আতরের ঘ্রাণ, নতুন টুপি, আর মায়ের হাতে এক চামচ সেমাই—এই ছিল ঈদের শুরুর স্বাদ।
ঈদের নামাজ মসজিদের মাঠে হইত। সবাই সাদা পাঞ্জাবি আর টুপি পরে হেঁটে হেঁটে যাইতো নামাজ পড়তে। নামাজ শেষে কোলাকুলি—এই ছিল ঈদের সবচেয়ে ভালো লাগার অংশ। যাদের সাথে সারা বছর দেখা হইত না, তারাও এসে বলত, “ঈদ মোবারক ভাই!” আমরা ছোটরা বড়দের কোল ধরে টাকা চাইতাম – ‘ঈদির’ নামে!
কোরবানির সময়
ঈদের নামাজের পরই শুরু হইতো কোরবানির প্রস্তুতি। গরুর গলায় ফিতে বাঁধা, মাথায় পানির ছিটা—সব মিলিয়ে এক আবেগঘন পরিবেশ। কোরবানির সময় মসজিদের ইমাম সাহেব দোয়া পড়ত, আমরা সবাই দাঁড়ায়ে থাকতাম। পশু কাঁপত, আমরা কাঁপতাম—এই এক বিচিত্র অনুভূতি।
গরু জবাইয়ের পর গ্রামের কসাইরা মাংস কাটত, বড়রা ভাগ করত তিন ভাগে—গরীব, আত্মীয় আর নিজেদের জন্য। মা বলত, “এই কোরবানির মাংসে বরকত আছে, সবার সাথে ভাগ করো।” আমরা মাংস নিয়ে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যাইতাম, সবাই হাসি মুখে বলত, “ঈদ মোবারক! কত বড় গরু কোরবানি হইছে!”
মাংস রান্না আর খাওয়ার মজা
মাংস রান্না শুরু হইলেই গোটা পাড়া এক মিষ্টি গন্ধে ভরে যাইত। মা চুলায় চাপা হাঁড়িতে পোলাও দিত, আর গরুর রেজালা, ভুনা, কালা ভুনা—সব এক এক করে বানাইত। পাড়ার লোকজন একে অপরের বাড়িতে দাওয়াতে যাইতো। একদিন জলিল কাকার বাড়ি, পরদিন সেলিম চাচার বাড়ি, আবার কেউ আমাদের বাড়ি আইতো। খাওয়া দাওয়ার পাশাপাশি গল্পগুজব, হাসি-ঠাট্টা চলত সারাদিন।
আমাদের সবচেয়ে মজা লাগত সেই সময়ে, যখন বন্ধুদের সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলতাম। কেউ গরুর চামড়া পাহারা দিত, কেউ মাংসের টুকরো নিয়ে ছুটে যেত আত্মীয়ের বাড়ি। সেই ছোট ছোট কাজেও কত আনন্দ ছিল!
ঈদের দুপুর-বিকেল
দুপুরের খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম, তারপর বিকেলের শুরু হইতো ঘুরাঘুরি। কেউ নদীর ঘাটে যাইতো, কেউ মাঠে ফুটবল খেলত। কেউ আবার নতুন জামা পরে ছবি তুলতে ব্যস্ত। গ্রামের মেলার মতো পরিবেশ হইতো ঈদের দিন – ছোট ছোট দোকান বসত, কোথাও বেলুন, কোথাও বাঁশির আওয়াজ। সন্ধ্যায় কেউ কেউ পুকুরপাড়ে গান গাইতো, কিশোররা দল বেঁধে ঘুরত, কেউ গরুর চামড়া বেচতে হাটে যাইত।
ঈদের পরে কিছুদিন
ঈদের পরের দিনগুলোতেও চলতো সেই খুশির রেশ। পাড়ার আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি দাওয়াত, ছেলেমেয়েদের খেলা-ধুলা, মাংস সংরক্ষণের চিন্তা—সব মিলিয়ে উৎসবটা দীর্ঘায়িত হইতো। মায়েরা বাসন মাজত, রান্না করত, আমরা ছেলেমেয়েরা দৌড়াদৌড়ি করতাম পুকুর, মাঠ আর বাঁশঝাড়ে। ছোট একটা পাড়ায় কত যে আনন্দ, তার হিসেব নাই।
শৈশবের ঈদ মানেই আবেগ
এখন শহরে থাকি, বড় হইছি, কিন্তু শৈশবের সেই ঈদের আনন্দ আর পাই না। অনেক দামি জামা, দামি খাবার, তবু মনে হয় কিছু একটা কম। কারণ সেই আবেগ, সেই আন্তরিকতা, সেই গ্রামের সরলতা আর মায়া—তা আর ফেরে না।
জলিল সরদার পাড়ার সেই দিনগুলা এখন স্মৃতির পাতায়। মনে পড়ে মা ঈদের সকালে হাতে সেমাই দিয়ে বলত, “যাও, নামাজ পড়ে এসো।” বাবা বলত, “চোখে যেন পানি না আসে কোরবানির সময়।” পাড়ার বন্ধুরা, চাচা-কাকা-খালা-মামা—সবাই এক পরিবার ছিলাম যেন।
উপসংহার
শৈশবের ঈদ শুধুই একদিনের উৎসব ছিল না, ছিল এক বন্ধনের সময়। কোরবানির ঈদ মানেই ত্যাগ, ভালোবাসা আর ভাগাভাগির শিক্ষা। ছোট্ট একটা পাড়া, সরল জীবন, আর ভালোবাসায় ভরা সম্পর্কের মাঝে কেটেছে আমাদের সেই রঙিন দিনগুলি। এখন শুধু স্মৃতি, কিন্তু সেই স্মৃতিতেই খুঁজে পাই জীবনের আসল সৌন্দর্য।
Facebook Comments Box
এই ক্যাটাগরির আরও খবর
© স্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ ইচ্ছাশক্তি
Theme Customized By Shakil IT Park