কোরবানির আসল মানে
মোহাম্মদ ফয়সাল
বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে আছে আট বছরের রাফি। তার চোখে জল টলমল করছে। বড় আদরে বড় হওয়া তাদের গরু “কালু” আজ কোরবানি হবে। কালুর গলায় নতুন লাল ফিতা বাঁধা, শরীর ধুয়ে চকচকে করে দিয়েছে বাবা। অথচ রাফির মনটা ভার।
—“কালু যাবে, মা?”
—“হ্যাঁ বাবা, আজ ওর জন্যই তো এত আয়োজন।”
—“ও তো আমার বন্ধু… কিভাবে ওকে কোরবানি দিবো?”
মা হাসলেন, আদর করে বললেন,
—“আল্লাহর রাহে দিলে যা দাও, তা ফেরত আসে বড় করে। আর কোরবানি মানে শুধু পশু কাটাই না, মানে ত্যাগ শেখা। কষ্ট হলেও মন থেকে দান করতে শেখো, সেটাই ঈদের শিক্ষা।”
রাফি কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সে দেখে, বাবা গরুর জন্য দড়ি তৈরি করছেন, চাচা আস্তে আস্তে ছুরি শান দিচ্ছেন। পাশের বাড়ির হাসান কাকার মুখে একরাশ খুশি। তিনি গরু কিনতে পারেননি, তবু বলছেন—“আলহামদুলিল্লাহ, ভাগ পাবো, আল্লাহর রহমত!”
নামাজ শেষে সবাই উঠানে ফিরে আসে। কোরবানির পর রক্ত ধুয়ে ফেলা হয়, আর শুরু হয় মাংস ভাগ। মা-ই ভাগ করেন তিন ভাগে—এক ভাগ নিজেদের জন্য, এক আত্মীয়-স্বজনদের জন্য, আর এক ভাগ গরিবদের।
রাফি দেখে, মা প্লেটে মাংস সাজিয়ে রেখেছেন কয়েকজন দরিদ্রের জন্য। রাস্তায় থাকা রিকশাচালক রহিম চাচা, যার নিজের কিছুই নেই, এসেছেন ছোট্ট ছেলেটাকে নিয়ে। মা হাসিমুখে বলেন,
—“চাচা, এটা আপনার জন্য, ঈদের দোয়া করবেন।”
রাফি চুপচাপ সেই দৃশ্য দেখে। রহিম চাচার চোখে জল, কিন্তু ঠোঁটে হাসি। তিনি বলেন—
—“আপনাদের জন্য দোয়া করি বেটা, আল্লাহ যেন হাজারগুণ ফেরত দেন।”
পরে মা রাফিকে কাছে ডেকে বলেন,
—“দেখো রাফি, শুধু গরু কোরবানি করলেই ঈদের কাজ শেষ হয় না। গরিবের মুখে হাসি ফোটাতে পারলেই কোরবানির মানে পূর্ণ হয়। আর আত্মীয়স্বজন যারা দূরে থাকে, তাদেরও মনে রাখতে হয়। ত্যাগ যদি নিজের ভিতরে না আসে, তবে পশু কাটা শুধু একটা কাজ হয়ে দাঁড়ায়, ইবাদত হয় না।”
রাফি মাথা নিচু করে বলে—
—“মা, আমি বুঝেছি। কালুকে ভালোবাসতাম বলেই আজ কষ্ট হলো। কিন্তু আমি চাই আল্লাহ যেন খুশি হন।”
সন্ধ্যায় যখন সবাই মাংসের খাবার নিয়ে খেতে বসেছে, তখন রাফি নিজের হাতে একটা প্লেট সাজিয়ে পাশের ঘরের বিধবা মাসুমা খালার বাসায় দেয়। খালার চোখেও অশ্রু—
—“তুই অনেক বড় হইছস রাফি।”
রাতের আকাশে তখন চাঁদ ঝলমল করছে। বাতাসে ভেসে আসছে রান্নার ঘ্রাণ আর ছোট ছোট মিষ্টি হাসি। রাফির মনে আর দুঃখ নেই, বরং একটা শান্তি। সে জানে, আজ সে শুধু একটা পশু হারায়নি, বরং কিছু পেয়েছে—ত্যাগের মধুরতা, ভালোবাসার গভীরতা আর ঈদের আসল মানে।