লেখক; জাকির আলম
শেষ চিঠিটা কবে ডাকবাক্সে পাঠিয়ে ছিলাম মনে নেই। অথচ সেই চিঠির প্রতিত্তোর পাওয়ার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে অনেকটা বছর কেটে গেছে। স্মতির পাতায় জমা হয়েছে অনেক পাওয়া না পাওয়া বিষাদের গল্প। বয়সের ছাপ এসেছে শরীরের ভাঁজে ভাঁজে। অনুভূতি জুড়ে এখন সংশয়ের বিড়ম্বনা। ভালো থাকার দিনগুলো ইতোমধ্যে শেষ হওয়ার পথে। চোখের জল শুকিয়ে চৌচির দহনে পুড়ে ভস্ম হয়ে গেছে পাঁজরের মাংসপিণ্ড। ধোঁয়াশার অন্ধকারে তলিয়ে গেছে বিরাণ ভূমি। অথচ আমাকে ভালোবাসার সময় আপনার হলো না। শুনেছি আপনি অনেক অভিমানী। কিন্তু এতটা আত্মকেন্দ্রিক কখনো জানা ছিল না। রোজ আপনার সাথে কথা বলার অপেক্ষায় থাকি। কখনো আপনার পুরনো স্মৃতি আওড়াতে আওড়াতে হেঁটে যাই পাতালপুরী পথে। আপনার মন খারাপের দিনগুলোতে ছায়ার মতো পাশে থেকেছি। কখনো বিপদে পড়লে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। নিজের সর্বস্ব বিসর্জন দিয়েও আমি আপনার প্রিয়জন হয়ে উঠতে পারিনি। ভেবেছিলাম কোনো একদিন আপনি আমার ভালোবাসা বুঝবেন।
বুকে টেনে নিবেন পরম ভালোবাসায়। কিন্তু সেই ভাবনা আমার চরম মিথ্যে ছিল৷ শুনেছি আমার জন্য আপনার কোনো অনুভূতি নেই। আমি কষ্ট পেলে আপনার তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। আমার প্রতি আপনার এত অবহেলা বুঝতে পারিনি কখনো। বুঝতে পারলে কখনো আপনাকে বিরক্ত করতে আসতাম না। যখন বুঝতে পারলাম তখন আমার ফিরে আসার সব পথ বন্ধ। তবুও আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাবো না। ধুঁকে ধুঁকে নিজেকে শেষ করে দিব তবুও আর কখনো আপনার সান্নিধ্যে আসবো না। বেঁচে থাকা অব্ধি আপনাকে আর মুখ দেখাবো না। পৃথিবীটা গোল। চলার পথে কখনো আপনার সাথে দেখা হলে তৎক্ষনাৎ আমি আমার গন্তব্য ফিরিয়ে নিব। মেনে নিব আমার ভাগ্য রেখা। জন্মের পর থেকে আমি হাসতে ভুলে গেছি। বারংবার ভুল করতে করতে নিঃশেষ হয়ে গেছি আমি। হারিয়ে গেছে মুখের ভাষা। মরে গেছে স্বপ্নগুলো। হৃদয় ফাটা আর্তনাদে কর্ণ যুগল বধির হয়ে গেছে। ভুলে গেছি বংশ পরিচয়। এতৎ সত্ত্বেও নিজেকে মেলে ধরতে চেয়েছি বারংবার। ভুল মানুষকে ভালোবাসার চেয়ে বড় আঘাত আর কিছুতে হতে পারে না।
পরিপাটি একটা সাজানো গোছানো জীবন আমারো ছিল। কালের চক্রে কেমন করে এমন নষ্ট হয়ে গেলাম বুঝে উঠতেই পারলাম না। অথচ যার জন্য আমার এই করুণ পরিণতি সে দিব্যি সুখে আছে। আমার জন্য তার মনে কোনো ভাবনা নেই। আমি নিজে এতটা বোকা কখনো আন্দাজ করতে পারিনি। বোকা না হলে কেউ নিজের সবকিছু বিসর্জন দিয়ে আপনাকে ভালোবাসতো না। আমার কষ্টের দিনে হাসি মুখে আপনার মুখ ফিরিয়ে নিলেন। একটু সহানুভূতি দেখালেন না। কতটা সহজে ভুলে গেছেন আমার সাহায্যের কথা। কখনো তো আমি আপনার ক্ষতি করিনি। আপনাকে নিয়ে কোনো কটুক্তি করিনি। নিঃস্বার্থ ভাবে আপনাকে আমি ভালোবেসে গেছি। অথচ ভালোবাসার দায়ে আপনি আমাকে এতটা কষ্ট দিতে পারলেন ? আমার চোখে জল ঝরিয়ে খুব কি সুখ পেয়েছেন আপনি ? আপনার দেওয়া মানসিক অত্যাচারে আজ আমি ক্ষত-বিক্ষত হয়েছি। আমার বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিপরীতে আপনি অনেক সুখে আছেন। শুনেছি আপনি অন্য কাউকে ভালোবাসেন। তাকে কাছে পাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আমিও চাই অন্য কাউকে নিয়ে আপনি সুখে থাকেন। আপনার প্রতি আমার কোনো দাবি-দাওয়া নেই। শুধু বলবো আমার মতো কাউকে এত কষ্ট দিয়েন না।
বিনা দোষে কাউকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েন না। মন ভাঙার আঘাত সবাই সইতে পারে না। অবশ্য আপনি বুঝবেন না মন ভাঙার আঘাত কতটা ভয়ানক হতে পারে। কাউকে আমার মতো মিথ্যে স্বপ্নের প্রতিশ্রুতি দিয়েন না৷ কাউকে নিঃস্ব করে আমার মতো মাঝ পথে ছেড়ে দিয়েন না। প্লিজ কাউকে আমার মতো এতটা আঘাত দিয়েন না। বাড়িয়ে দিয়েন না কারো দীর্ঘশ্বাস। আমার মতো দ্বিতীয় কাউকে আর ঠকিয়ে দিয়েন না। আপনার পায়ে পড়ি আর কারো সাথে মিথ্যে ভালোবাসার অভিনয় কইরেন না। আমিও চাই নির্দিষ্ট কাউকে নিয়ে আপনি অনেক সুখী হোন। আপনি তার স্বপ্নের মানুষ হয়ে উঠুন। কারো ভালোবাসার অপেক্ষা হোক আপনাকে ঘিরে। আপনার ভালোবাসা পেয়ে কেউ একজন স্নাত হোক। আপনাকে ঘিরে হোক তার সকল চাওয়া-পাওয়া। এতৎ সত্ত্বেও আপনার মুখে হাসি দেখলে আমার ভালোলাগে। আপনার চুলের ভাঁজে ভাঁজে অন্য কারো হাতের ছোঁয়া দেখলে ভালোলাগে। আপনাকে কখনো আমি ঘৃণার চোখে দেখতে পারবো না। ভালোবাসার মানুষের জন্য কোনো ঘৃণা থাকতে নেই। আমিও চাই আপনি আমাকে আমৃত্যু ভুলে থাকেন। কিন্তু আপনাকে ভুলে যাওয়ার কোনো অবকাশ আমার নেই। আমার সব ভাবনা শুধু আপনাকে ঘিরে।
আপনার দেওয়া সকল আঘাত আমি ফুল ভেবে মনের ক্যানভাসে সাজিয়ে রেখেছি। সময় পেলে একদিন এসে দেখে যাবেন। আপনার জন্য আমার মনের দরজা সবসময় খোলা। কারো সাধ্য নেই আপনাকে বাঁধা দেওয়ার। কিন্তু কখনো আপনি আর আমাকে দেখতে পাবেন না। আমি মিলিয়ে গেছি অদৃশ্য প্রকৃতির মাঝে। অনেক রহস্যের জাল বুনে আমাকে বিছিয়ে দিয়েছি বিশাল আকাশ জুড়ে। একদা বলেছিলেন আমাকে নিয়ে আপনি পুরো পৃথিবী বিচরণ করবেন। পাহাড়ি ঝর্ণায় আমার বুকে মাথা রেখে আপনি অনেক ভিজবেন। ঝুম বৃষ্টির দিনে আমার সাথে অনেক খুনসুটি করার প্রতিশ্রুতি ছিল আপনার। আপনার বলা সব কথাই আমি আত্মস্থ রেখেছি। ভুলে যাইনি কোনো কথা। একটা সময় আপনার কণ্ঠ শোনার জন্য মুঠোফোনের এপারে আমি অনেক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম। রোজ আপনার সাথে দেখা করতে চাইতাম। আপনার মুখের হাসি শোনার জন্য হাজারো কথার ফুলঝুরি সাজাতাম। অথচ সেই আপনি আজ আর আমার নেই। আমার থেকে আপনি অনেক দূরে সরে গেছেন। ভুলে গেছেন পুরনো সব স্মৃতিগুলো।
একটা সময় হয়তো আমাকে আপনার ভীষণ মনে পড়বে। একটু কথা বলার জন্য দিওনা হবেন। কিন্তু তখন হয়তো আমি আর থাকবো না এই পৃথিবীতে। সাড়া দিতে পারবো না আপনাকে। কথায় আছে মানুষ যখন যা চায় তখন তা পায় না। যখন পায় তখন তা চায় না। আপনিও হয়তো তখন আমার জন্য আফসোস করবেন। নিজের ভুল বুঝতে পারবেন। হয়তো ক্ষমা চাওয়ার জন্য অনেক অনুশোচনায় ভুগবেন। কিন্তু আমাকে পাবেন না। আমি সেদিন চলে যাব অন্তহীন পৃথিবীর পথে। সেদিন আপনার ডাক আমার কান অবধি পৌঁছাবে না। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হবে না পায়ের তালু। ক্রমাগত হাঁটতেই থাকবো বিমূর্ত মনোভাবে। সেদিন হয়তো আপনার প্রতি আমার মনে প্রচণ্ড অভিমানের জন্ম নিবে। শত ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও দেহ মন ফিরে তাকাবে না আপনার দিকে। আপনার চোখে জল ঝরলেও অনুভূতিহীন হয়ে যাব আমি। হয়তো তৎক্ষনাৎ আপনি ভূপৃষ্ঠে লুটিয়ে পড়বেন। এদিকে আমিও অদৃশ্য হয়ে যাব সম্মুখের পথে। কেউ কাউকে আর দেখা হবে না। চাওয়া-পাওয়ার অনেক ঊর্ধ্বে চলে যাব আপনি আমি। কেউ কাউকে ভালোবাসি বলা হবে না মানব জন্মে। আপনি আমি দুজনেই একদিন হেরে যাব প্রকৃতির পালাবদলে। থমকে যাবে আমাদের সব অনুভূতিগুলো।
ধূলোয় মিশে যাবে আমাদের ভালোবাসার স্মৃতি চিহ্ন। ফুল ঝরে গেলে যেমন তার কোনো মূল্য থাকে না তেমনি আমাদের বিচ্ছেদ হওয়ার পর জোড়াতালির সম্পর্কগুলো অমানিশার অন্ধকারে তলিয়ে যাবে বড্ড অবহেলায়। বেড়ে যাবে কষ্টের পরিসীমা। অথচ আমাদের কিছু করার থাকবে না। বেড়ে যাবে একে অপরের প্রতি অভিমানের ক্ষোভ। মনের কষ্টগুলো মুক্তির জন্য ছটফট করবে। একটু আলোর জন্য শরীরটা ছোটাছুটি করবে। ঘাম ঝরতে থাকবে পুরো শরীর থেকে। ক্ষুধার পরিধি বহুগুণে বেড়ে যাবে। তবুও আমাদের দেখা হবে না। কথা হবে না মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। অভিযোগের তীর ছুড়তে পারবো না কেউ কারো দিকে। তবুও আমাদের একে অপরকে কাছে পাওয়ার তৃষ্ণা অনেক বেড়ে যাবে। মন চাবে একে অপরকে ছুঁয়ে দেখি। আদতে ভালোবাসার চেয়ে কষ্টের অনুভূতি পৃথিবী জুড়ে আর দ্বিতীয়টি নেই। তবুও এই ভালোবাসার পিছনে আমাদের কত তিতিক্ষা থাকে।
আপনি যদি ভুল করেও আমাকে একটু ভালোবাসতেন তাহলে এতটা কষ্ট আমার কোনোদিন হতো না। আপনার অবহেলিত ভালোবাসার কষ্টে নিমজ্জিত আমি। সেখান থেকে কোনো মুক্তি নেই। আপনি আমাকে খা খা রোদ্দুরে নিক্ষেপ করে দিলেন। একটু দয়ার বশবতী হয়ে বুকে টেনে নিলেন না। আপনাকে ক্ষমা করার মতো দোষ আপনি করেননি। তবুও অপরাধীর চোখে আপনাকে দেখতে পারিনি। আমি নিজেও বুঝে উঠতে পারিনি কেন এত আপনাকে ভালোবাসতে গেলাম। যে ভালোবাসার অভিশাপে ক্ষত-বিক্ষত আমি। আপনি আমার সাথে যা করলেন তা ভুলতে পারবো না কোনোদিন। তবুও সবকিছু ভুলে যাওয়ার প্রচেষ্টায় নিজেকে সমাধি দিলাম নরকের অভ্যন্তরে। আপনি আপনার মতো নিরাপদে থাইকেন। আর কখনো আমার মতো কাউকে জেনে-বুঝে আঘাত দিতে যাইয়েন না। ভালোবাসার আঘাত মৃত্যুর চেয়েও অনেক বেশি কষ্টের। অনেক বেশি যন্ত্রণার। যা সহজে সইতে পারে না কেউ।