বিলাশপুর। এক ছোট্ট গ্রাম, দূরের মাঠ পেরিয়ে যেখানে হঠাৎ ঘন জঙ্গল এসে নামে, আর তার বুক চিরে দাঁড়িয়ে আছে এক প্রাচীন তেতুল গাছ। সেই গাছের ডালগুলো যেন কঙ্কালের হাত, রাতের অন্ধকারে ছায়া ফেলে কবরের ওপর। বাতাসে শুকনো পাতা উড়ে যায়, আর মাঝে মাঝে শোনা যায় ফিসফিস শব্দ, যেন গাছের শিকড়ের ফাঁক থেকে কারো কান্না ভেসে আসে।
গ্রামের বাচ্চারা ওই গাছের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, “ওখানে আছে জমিলা… ও আমাদের দেখে…” বুড়িরা মুখ চেপে হাসে, কিন্তু রাতে দরজা বন্ধ করে ঘুমায়। আর যেই বাড়ি থেকে তেতুল গাছ দেখা যায়, তার জানালায় ছোট্ট প্রদীপ জ্বলে থাকে, যেন অন্ধকার ঠেকানোর শেষ চেষ্টা।
গ্রামের পুরনো গল্পগুলো বলে, বহু বছর আগে জমিলা নামে এক মেয়ে ছিল—অত্যন্ত সুন্দরী, কোমল হাসি, কিন্তু ভাগ্য বড় নির্মম। কোনো এক জমিদারের ছেলের সাথে জমিলার প্রেম ছিলো। জমিলা ছিলো তার কৃষক বাবার একমাত্র সন্তান। ছেলেটির নাম ছিলো সাজিদ। জমিলা ও সাজিদ ছিল একই বৃন্তের দুটি ফুল। একে অপর খুব বেশি ভালোবাসত। সাজিদের জমিদার পিতা বিষয়টি জানার পর পড়ালেখার অযুহাতে সাজিদকে বিলেত পাঠিয়ে দেন। সাজিদ বিদেশ চলে গেলে, তার বাবার সাঙ্গপাঙ্গরা জমিলাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। জমিলাকে বন্ধি করে রেখে দিনের পর দিন নির্যাতন করে। এক ঝড়ের রাতে জমিলাকে হত্যা করে সেই তেতুল গাছের শিকড়ের নিচে পুঁতে ফেলে। সেই রাত থেকে, গাছটা আর সাধারণ থাকেনি। রাত নামলেই, বিশেষ করে পূর্ণিমায়, সেখানে দেখা যায় সাদা শাড়ি পরা এক ছায়া, চোখে শূন্যতা, পায়ে শিকলের দাগ, আর কণ্ঠে ফিসফাস: “ সাজিদ … তুমি কি আমাকে ভালোবাসবে?”
সেই গ্রামে একদিন এসে পৌঁছায় সানজিদ। শহরের প্রেম-ভাঙা এক তরুণ শিক্ষক, নতুন জীবনের আশায় সে এখানে এসেছে। কিন্তু গ্রামে পা রাখা মাত্রই সে টের পায়, বাতাস এখানে ভারী, আলো এখানে কেমন নিভু নিভু, আর রাত এখানে কখনো সত্যি শেষ হয় না।
সানজিদ বিজ্ঞানমনস্ক লোক। সে ভূত প্রেতে বিশ্বাস করে না। সানজিদের আরেকটি গুণ আছে। সে একজন কবি, কবিতাই যেন তার জীবন। ভৌতিক সেই তেতুল গাছও যেন তার ভয়ের ধারেকাছেও ঘেষে না। প্রায়ই সে তেতুল তলায় বসে কবিতা লিখে। গ্রামের লোকেরা তাকে সাবধান করে বলে , “মাস্টারবাবু, ওই গাছের নিচে বসিস না, ওখানে পেত্নি থাকে। নাম জমিলা।” সানজিদ শুধু মুচকি হাসে। ও তাদের বুঝায় ভূত প্রেত বলে কিছুই নেই। লোকেরা বলে, ” মাস্টারবাবু, আমরা অনেক বার জমিলাকে দেখেছি। আমরা কি নিজের চোখকে ভূল বলবো। ” সানজিদের কথা যেন আটকে যায়, তাদের মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। পরক্ষণেই আবার মন দেয় কাজে।
গ্রামের লোকের কথায় সানজিদের বিশ্বাস হয় না, কিন্তু আবার ভয়ও হয়। সে জমিলা আর সাজিদের ঘটনা মনে মনে ভাবে। নিজেকে প্রশ্ন করে সাজিদের শেষ পরিণতি কি হয়েছিলো। কেউই তার শেষ পরিণতির গল্পটা জানে না। সানজিদের মনে কৌতুল জাগে এই জমিলা আর তেতুল গাছের ঘটনা জানার। সে ঘর থেকে বের হয় তেঁতুলতলার উদ্দেশ্যে। যখন সে তেতুল তলার কাছাকাছি পৌছায়, তার দৃষ্টিতে পড়ে একটি বিড়াল। এমন বিড়াল সে আগে কখনো দেখে নি, বিড়ালের চোখ দুটি যেন জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি যার থেকে আলোকবিন্দু বিচ্ছুরিত হয়ে চারপাশে লাল আভা ছড়াচ্ছে। সানজিদের বুক ধক করে উঠে। একটি ঢোক গিলে কৌতুহলের তাড়নায় সে সামনের দিকে পা বাড়ায়। ম্যাও, ম্যাও শব্দ করে বিড়ালটিও তার পিছু নেয়। কিন্তু সানজিদ সে দিকে না থাকিয়ে সোজা চলতে থাকে। সানজিদ যখন তেতুল তলার থেকে প্রায় দশ ফুট দূরে পৌছায় তখন সে অনুভব করে হাওয়া ভারি হয়ে গেছে , আর কুয়াশার ভেতর থেকে ভেসে আসছে ফিসফিস শব্দ, তখন তার বুক কেঁপে ওঠে। সে টের পায়, কেউ একজন তাকে দেখছে , ভয়ে সানজিদের গলা শুকিয়ে যায়। হঠাৎ তার পাশ থেকে অদ্ভুত হাসির শব্দ ভেসে আসে। একটা ছায়া তার সামন দিয়ে দ্রুততার সাথে চলে যায়। সানজিদের গলা শুকিয়ে যায় চোখের ভাসে সাদা শাড়ি পরা, এলোমেলো চুল, চোখে গভীর শূন্যতা, আর পায়ে শিকলের দাগ নিয়ে তেতুল গাছের নিচে দাড়িয়ে আসে এক কিশোরী । সে মৃদু হাসে, বলে, “কবি, তুমি কেন এলে? তুমি কি আমায় খুঁজছো?”
সানজিদ কাঁপা কণ্ঠে বলে, “তুমি কে?” জমিলা হাসে, “আমি এক গল্প, যে গল্প কোনো দিন লেখা হয়নি, যে শুধু ছায়ায় থেকে গেছে… তুমি কি আমায় লিখবে?” সানজিদ যেই কিছু একটা বলতে যাবে তখনই সামনের ছায়া অদৃশ্য হয়ে যায়। বিকট শব্দে ভেসে আসে কান্নার আওয়াজ, যেন সানজিদের সহ্যসীমার বাইরে চলে গেসে। সানজিদ ভয়ে চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
#চলবে…