রেললাইনের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে আবিরের চোখে ভেসে উঠছিল শৈশবের সেই বিকেলগুলো। ছোট্ট একটা গ্রাম—নাম খয়েরবাড়ি। গাছে ভরা, মাঠে ভরা, সরল মানুষের হাসিতে ভরা এক খণ্ড শান্তির পৃথিবী। এখন সে শহরের ব্যস্ত মানুষ। কোট-টাই পরে অফিসে যায়, সন্ধ্যায় ট্রাফিক ঠেলে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফেরে। কিন্তু এই মুহূর্তে, তার ভেতরে এক অদ্ভুত শূন্যতা। এইজন্যই সে এসেছিল এখানে, যেখানে সব শুরু হয়েছিল।
আবিরের বয়স তখন বারো। স্কুল শেষে প্রতিদিন সে আর তার তিন বন্ধু—জিতু, রাকিব আর মনির—রেললাইনের পাশে বসে আকাশ দেখত। সাদা তুলোর মতো মেঘগুলো কী যেন বলত তাদের কানে কানে। তারা স্বপ্ন দেখত—কে হবি পাইলট, কে হবি পুলিশ, কেউ বা কবি। একেকটা স্বপ্ন একেকটা গল্প হয়ে মিশে যেত বাতাসে।
“আবির, চল ফুটবল খেলি,” জিতুর সেই ডাক আজও যেন কানে বাজে।
স্কুলের মাঠটা তখন ছিল তাদের যুদ্ধক্ষেত্র। হার-জিত মানেই ছিল না, ছিল শুধু একটুখানি আনন্দের খোঁজ। ছেঁড়া বল, খালি পায়ে দৌড়, আর শেষে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়া—এই ছিল তাদের বিকেলের রুটিন। সন্ধ্যা হলেই মায়ের চিৎকার, “আবির! কোথায় গেলি? আয়, খাওয়া দে!”
সে সময় টিভিতে ছিল মাত্র একটা চ্যানেল—বাংলাদেশ টেলিভিশন। রাত আটটার নাটক দেখতে দেখতে মা রান্না করতেন, বাবা পেপার পড়তেন, আর আবির মাটিতে পাটি পেতে পড়ে থাকত। বাবার কণ্ঠে কবিতার আবৃত্তি শোনার আনন্দ আজকের পৃথিবীর কোনো কিছুতেই পাওয়া যায় না।
সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিল দাদু। গল্পের রাজা বলা হতো তাকে। প্রতিদিন রাতে তিনি আবিরকে গল্প শোনাতেন—বগুড়ার মহাসাগরের নিচে থাকা সোনা খনির কথা, বা জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া রাজকন্যার কাহিনি। আবির বিশ্বাস করত, সবই সত্যি। সত্যিই তো, তখনকার বিশ্বাসই তো ছিল জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস।
সময়ের চাকা ঘুরল। মাধ্যমিকের পর শহরে চলে যেতে হলো। সেই ছোট্ট ঘর, সেই মাঠ, সেই বন্ধুরা, সব কিছু একে একে ছুটে গেল দূরে। রাকিবের পরিবার চলে গেল চট্টগ্রামে, মনিরের বাবা মারা গেল, জিতু একদিন চিঠি লিখে জানাল সে বিদেশ চলে যাচ্ছে চাচার সঙ্গে। তারপর আর কোনো খোঁজ নেই।
শহর তাকে বড় করল ঠিকই, কিন্তু ভেতরটা ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে গেল। হাজার হাজার মানুষের ভিড়েও কোথাও যেন একা হয়ে পড়ল সে।
আজ অনেক বছর পর, হঠাৎ করেই ছুটে এসেছে খয়েরবাড়িতে। বুকের ভেতরে একচিলতে কান্না চেপে রাখা। সে পা রাখল সেই পুরোনো স্কুল মাঠে। ঘাস অনেক উঁচু হয়ে গেছে, কোথাও কিছুই নেই আগের মতো। স্কুল ভবনের দেয়ালে আগাছা, জানালার কাঁচ ভাঙা। কিন্তু তার মনে হচ্ছে—ঠিক এই জায়গাতেই তো জিতু গোল করেছিল, মনির হাওয়ার মতো দৌড়েছিল।
হঠাৎ পিছন থেকে এক কণ্ঠস্বর, “আবির?”
সে চমকে পিছনে তাকাল। পাকা চুল, মুখে বয়সের ছাপ, কিন্তু চোখদুটো এখনো আগের মতোই। জিতু!
কোনো কথা হয়নি কয়েক সেকেন্ড। তারপর দু’জনেই জড়িয়ে ধরল একে অপরকে। যেন হারিয়ে যাওয়া শৈশবটা ফিরে এল হঠাৎ।
চা দোকানে বসে তারা গল্প করল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। রাকিব এখন মালয়েশিয়ায়, মনির মারা গেছে তিন বছর আগে, ক্যান্সারে। খবর শুনে আবির স্তব্ধ। মনে হলো শৈশবের আরেকটা পাতা চিরতরে ছিঁড়ে গেল।
রাতে সে গেল দাদুর কবরের পাশে। একমুঠো মাটি হাতে নিয়ে বলল, “দাদু, তোমার গল্প আমি এখনও মনে রেখেছি। কিন্তু আমার গল্পটা যেন কোথায় হারিয়ে গেছে।”
তারপর সে ফিরে গেল রেললাইনের ধারে। ভোরের আলো ফোটে ফোটে উঠছে। পাখির ডাক, শিশিরভেজা ঘাস, দূরে ভেসে আসা আজানের ধ্বনি—সব মিলে এক অদ্ভুত শুদ্ধতা যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে।
আজ আবির বুঝতে পারল—শৈশব কোনো হারানো সময় নয়, এটা একধরনের আলো, যা সারা জীবন মনে পড়ে… বুকের গহীনে বাজতে থাকা কোনো পুরোনো গানের মতো।