মেজো বোনের অসুস্থতার কারনে, তার সেবা শুশ্রূষার জন্য আমার মা এবং ভাগিনা আবির সহ আমরা ৩ জন, কয়েক দিন আগে যাত্রা করেছিলাম চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশ্য। কিছুদিনের মধ্যেই আল্লাহর রহমতে, আপা কিছুটা আরোগ্য লাভ করেন আলহামদুলিল্লাহ।
মা আর আবির সেখানে কিছুদিন থাকতে চাইল এবং আমার আসলো বাড়ি ফেরার পালা, বাল্যবন্ধু ইউসুফ (কালু) ফোন কলের মাধ্যমে অনুরোধ জানাল, তার সাথে যেন দেখা করি এবং ঢাকায় তার বাসায় কিছুদিন থাকি। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারনে তা আর হয়ে ওঠেনি, মাত্র একদিন কালুর বাসায় থেকে পরের দিন রওয়ানা দেই, গ্রামের বাড়ি গলাচিপার উদ্দেশ্য। কিন্তু আজ অমাবস্যা রাত সেটা আমার স্বরন ছিলনা। তখন রাত ১২.৩০ এর মত, খেয়াঘাট থেকে গাড়ি না পেয়ে হাঁটা শুরু করলাম, থানার সামনে দূজন পূলিশ অফিসার ছাড়া রাস্তায় একটা কুকুরের সন্ধান ও পেলাম না। হাটতে হাটতে কালীবাড়ি মন্দির পেড়িয়ে, রেন্ডিতলা ভূমি অফিসের সামনে, পেছন থেকে অগান্তুক ভাইয়ের ডাক, দারান ! খানিকটা চমকালেও মোটেই ভয় পাইনি কারন বিপদ যত ঘনিয়ে আসে আমার সাহস ততটাই বেড়ে যায় সবার প্রেসার যেখানে হাই সেখানে আমার লো, বললাম দাদা যাবেন নাকি সোমবারিয়া বাজার?? রিকশাওয়ালার অট্রহাসি জনিত রহস্যময় উত্তর !! আরে দাদা তুমি পাগল নাকী? এত রাতে কোথা থেকে পালিয়ে এসেছো হুম !! দেখেতো মনে হয় খুবই ভদ্রলোক তা এত রাতে একা একা কোথায় যাচ্ছেন? আমি থ,,, হয়ে দাড়িয়ে গেলাম, আসলে এই রিকশাওয়ালা কে আমি কখনো কোথায়ও দেখিনি, তার কথায় চমকে উঠলেও স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলাম, আরে ভাই কী যে বলেন! পালিয়ে আসব কেন আর তাছাড়া রাত বেশি বাজলো ও বা কোথায়?
আমি ঢাকা থেকে আসছি। চলেন না, সোমবারিয়া বাজার দিয়ে আসেন কোনো গাড়ি পাচ্ছিনা, লোকটা মৃদু হেসে বলল না, না, বাপু আমি যাচ্ছিনা। ব্যাস কোনো কথা না বলেই গম্ভীরভাবে হাটতে শুরু করলাম কিছুটা দূর যেতেই অফিসার্স ক্লাব পেরিয়ে লিপি সিনেমার কাছাকাছি, সেই লোকটাই এসে বলল, চলেন দাদা দিয়ে আসি। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে বসলাম, সে খুব জোরে গাড়ি টানছিল আর বলা শুরু করল জিগ্যেস করা ছাড়াই তার বিষয়ে এলোপাতারি গল্প -স্বল্প, বিরক্তিকর হলেও তিনিই তো একমাত্র সফরসঙ্গী, তাই চুপচাপ তার বকবক সহ্য করতে লাগলাম, হঠাৎ মুরাদনগর পেরিয়ে কুমার বাড়ির সীমানায় এসে বলল দাদা গাড়িতে চার্জ কম লো’ মারে,আমি বোধহয় ফিরে আসতে পারব না! এ জাতীয় অদ্ভুত কথাবার্তা, ভাবছি হয়তো অতিরিক্ত টাকা লুফে নেওয়ার ধান্দা, কিন্তু নিজেই বুঝতে পারলাম সে সত্যি বলতেছে, কী করব ভেবে পাই না তাকে বললাম গাড়ি ধীরে চালান চার্জ সাশ্রয় হবে। একা একা হেটে যেতে হবে কয়েক মাইল দূরে, তাও আবার এই বিদঘুটে অন্ধকার রাতে, ভাবতেই গা’ ছমছম করা শুরু করল এবং লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল। দীর্ঘসময় ইন্টারনেট কানেশন না থাকায়, ডাটা অন করার পর ও মেসেনজারে ঢুকতে পারতেছিলাম না, অনেক কষ্ট শেষে আমার বন্ধু আজিজুল কে নক করলাম। সাথে সাথে ও জিজ্ঞেস করল তুমি এখন কোথায়? আসলে ও জানত না আমি বাড়ির পথে, আমিও বললাম তুমি কোথায়?
দুটি বার্তার ধাক্কায় মারাত্মক দূর্ঘটনা ঘটত, যদি বার্তাদের প্রান থাকত এতটাই একসময়ে পৌছেছিল বার্তা দুটি, শুধু বলছিলাম রিকশার চার্জ নেই অমনি বুঝে গেছে আমি বাড়ির পথে! বলল কতদূর আসছো? বললাম ব্রীজ বাজার। সে বলল তুই ওখানে দাঁড়া, আমি বললাম বন্ধু থামো, আপাদত দাঁড়াও রিকশাটা দেখি সামনে যাওয়া যায় কিনা, সে এসব মেসেজ সিন না করেই ডাটা অফ না করেই, মোবাইল পকেট এ ঢুকিয়ে, তার মামার মোটরসাইকেল টি দরজার সামনে থেকে নিয়ে উড়াল দিছে, তার নানা জিজ্ঞেস করল কই যাও? কোনো উত্তর নেই। এ যেন, ছোটবেলার সেই ছড়াটির একটি অংশ, পাগলা ঘোড়া খেপেছে চাবুক ছুড়ি মেরেছে। রিকশা ওয়ালাকে বললাম ধীরে ধীরে আগান দেখি কোনো গাড়ি আসে কিনা অথবা আমার বন্ধু ও আসতে পারে, রিকশাওয়ালা হাসতে হাসতে বলতে লাগল মিয়া আপনি একটা পাগল টাইপের লোক, এই রাতে অতদূর থেকে আসবে!!! আপনার মাথায় কী সমস্যা? আমি বললাম আসতেই পারে সে আমার বন্ধু। বলে আর হাসাবেন না দাদা, হঠাৎ সামনে হুন্ডার সিগন্যাল, রিকশায় সামনে হার্ডব্রেক এ যেন সেই রুপকথার রাজ্যের পঙ্খিরাজ ঘোড়া নয়’তো বেঙ্গমা পাখি।
চোখ ফিরে তাকাতেই আমি তাজ্জব!! আশ্চর্য এত দেখতেছি আমার বন্ধু MD Arafat Hossain Azizul কীভাবে সম্ভব!! গাড়ি থেকে নেমেই বুকে জড়িয়ে ধরলাম, বন্ধু তুই’তো সেই মোটিভেশনাল বক্তা সোলায়মান শুখন এর কথার জবাব দেওয়ার উদাহরণ সৃষ্টি করে ফেললি, ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাইনা শুধু জানতে চাই কীভাবে আসলি? শুনলাম শুয়ে আছিস তাহলে ৩০ মিনিটের মত লাগা পথে মাত্র ৩ মিনিটে কী করলি, দেখলাম ও চেহারা থেকে ঘাম ঝরছে, সে উত্তর দিল এই আমাবস্যা রাতের বিদঘুটে অন্ধকারে তুই এই ভয়ঙ্কর পথে একা হাঁটবি বা দাড়িয়ে থাকবি, তাহলে বন্ধুত্বের আর কী থাকে। তখন শুনলাম আজ আমাবস্যা রাত, রিকশাওয়ালা হাসতেছে আর বলতেছে, ভাই আসলে এটাই মনেহয় বন্ধুত্ব আমি ভুল বুঝেছিলাম, কিন্তু সত্যিই বন্ধুত্ব এখনো বেঁচে আছে সঠিক এবং সৎ মানুষের হৃদয়ে আপনাদের জন্য দোয়া করি। রিকশা ভাড়া দিয়ে তাকে বিদায় দিলাম, চালু করে উটতে বলল, বললাম এতক্ষণ তো কষ্ট করলি তুই বিশ্রাম নে, আমি গাড়ি চালাই। বলল নারে তুইতো অনেকদূর থেকে জার্নি করে আসছিস আর আমি তোকে এগিয়ে নিতে আসছি তুই কেন গাড়ি চালাবি তুইতো হইলি মেহমান। বাহ্ বন্ধুত্ব প্রশান্তির একটা হিমেল হাওয়া বয়ে যায়, আমার কলিজার মধ্যে তাহলে সত্যি-ই আজ আমি সার্থক, কারণ আমার একটা সত্যিকারের বন্ধু আছে।
দু-জনে কথা বলতে বলতে কখন যে সোমবারিয়া বাজার পেরিয়ে আসছি জানা নেই, হঠাৎ পাকা শেষে কাঁচা রাস্তায় কাদার মধ্যে দিয়ে গাড়ি জোড় করে টানতে টানতে মিলঘড় পেরিয়ে গাজীদের ভিটার কাছাকাছি, বললাম থাম আর যেতে হবেনা হেঁটে যেতে পারব বলল আরে না ভয় পাবি সমানে তালগাছ, বনজঙ্গল, আজ আমাবস্যা রাত। তারপর ও সে গায়ের শক্তিতে গাড়িটা, হারুন হাওলাদার বাড়ির সামনে নিয়ে এল,অনেক জোড়াজুড়ি করে থামালাম। আমি হাটা শুরু করি সে-ভোঁ করে মৌমাছির মত চলে গেল এবং বাসায় গিয়ে আমাকে কল করল তার সারা শরীর কর্দমাক্ত ছিল, ফ্রেশ না হয়েও সে বলতে লাগল তুই বাড়ি পৌছানো অবধি আমি কল কাটবনা,যাতে তোর কোনো ভয় না করে এবং নিরাপদে বাড়ি পৌছাতে পারো, আমি কোনো কথা বলার মত শব্দ ই’ খুজে পাইনি।
সংক্ষিপ্ত- আজ ১৮ -ই ভাদ্র সোমবার দিবাগত রাত ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ২ রা সেপ্টেম্বর ২০২৪, (দিবা সোম, নিশি মঙ্গল) ২৬ সফর ১৪৪৬ হিজরি শরৎকাল।