ভালোবাসার সমীকরণ (৮ম পর্ব)
জাকির আলম
চলছে গ্রাম বাংলার নবান্ন উৎসব। কার্তিকের সোনালি ধানের মৌ মৌ গন্ধে অন্য রকম ভালোলাগার পরশ মাখে। সবাই ব্যস্ত ক্ষেতের আমন ধান কেটে ঘরে তুলতে। গ্রাম্য কৃষাণীরা আপন মনে কাজ করে চলেছে হাসি মুখে। তাদের মুখে কোনো ক্লান্তির ছাপ নেই। এলোমেলো হালকা শীতল বাতাসে ঢেউ খেলে যায় সোনালি ধানের শীষে। ভোরের কুয়াশা মাখা হালকা শিশির সবুজ ঘাসের উপর লেপটে থাকে। দোয়েল পাখির শিসে ঘুম ভাঙ্গে গ্রাম্য জনতার। সন্ধ্যা হতে না হতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে ঘরে ফিরতে। রাত এলেই ধুম পড়ে যায় নানা রকম পিঠা-পুলির আয়োজনে। কৃষাণীর হাতে খেজুর রসের পাটালি গুড়ের নতুন ধানের পায়েস ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয় সারাদিনের। ঐতিহ্যবাহী এ নবান্ন উৎসবে প্রতি বছর গ্রাম বাংলার আনাচেকানাচে নানা রকম বিনোদনের আয়োজন করা হয়। এই যেমন গ্রাম্য নাটক, পুথি পাঠ, লাঠি খেলা। এর মধ্যে চলে আরো কতো আয়োজন। বলতে গেলে নবান্ন এলেই গ্রাম বাংলায় নানা রকম উৎসবের ধুম পড়ে যায়। তখন গ্রামের মানুষগুলো অন্য রকম আমেজে আনন্দ মনে সময় অতিবাহিত করে। খুশির আমেজ যেন তাদের মনে ধরে না। প্রতি বছর নবান্ন উৎসবে যে নাটকের আয়োজন করা হয় তার অন্যতম কাণ্ডারি শ্রাবণ এবং মোনা। নাটক লেখা থেকে শুরু করে সব বিষয়ে শ্রাবণের সুনিপুণ দক্ষতা মেলা ভার।
শ্রাবণের অভিনয় প্রশংসা করার মতো। নাটকে যদিও মোনা অভিনয় করে না তবুও শ্রাবণের পাশে থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। নাটকে কোনো সত্যিকার মেয়ে রাখা হয় না। ছেলে মানুষ মেয়ে সেজে নাটকে অভিনয় করে। সারাদিনের কাজ শেষে সবাই একটু বিনোদনের খোরাক জোগাতে হাজির হয় শ্রাবণের নাট্য অনুষ্ঠানে। বেশির ভাগ সময় নাটকের নায়কের চরিত্রে অভিনয় করে শ্রাবণ। নাটকের অভিনয় দেখে দর্শক সারিতে হাসি আর হাত তালির হিড়িক পড়ে যায়। তখন অভিনয় শিল্পীদের ভালো অভিনয় করার প্রতি আরো বেশি মনোযোগ দেয়। এখানে যদিও কেউ পেশাদার অনিনেতা নয়, কিন্তু তাদের সুনিপুণ অভিনয় পেশাদার অভিনেতাদের মতোই নান্দনিক। সবাই চেষ্টা করে ভালো অভিনয় করার। নাটক শেষে সবাই আনন্দ মনে যে যার ঘরে ফিরে যায়। মোনা দর্শক সারিতে বসে শ্রাবণের অভিনয় দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারে না। এক সময় মোনাও নাটকে অভিনয় করতো। কিন্তু এখন অভিনয় করার ইচ্ছে থাকলেও আর করে না পরিবারের নিষেধাজ্ঞা থাকায়। সেজন্য মোনার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। পরিবার থেকে অভিনয় দেখার কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তাই যথারীতি হাজির হয় শ্রাবণের নাটকে অভিনয় দেখতে।
নাটকের পরিচালক, নির্দেশক, অভিনয় সবকিছু শ্রাবণ দক্ষতার সাথে করে থাকে। তার অভিনয়ে সবাই মুগ্ধ। মোনা শ্রাবণকে সব বিষয়ে উৎসাহিত করে। সবসময় পাশে থাকে। শ্রাবণের অভিনয়ে কোনো ভুল ত্রুটি হলে মোনা সেটা সংশোধন করে দেয়। শ্রাবণও সেটা গ্রহণ করে। এতে করে মোনাকে ধন্যবাদ জানাতেও শ্রাবণ ভুল করে না। শ্রাবণের জীবনে মোনার অবদান অনেক বেশি। যা বলে শেষ করা যাবে। হেমন্ত মোনার প্রিয় ঋতু হওয়ায় অনেক রাত অবধি দু’জনে গল্প করে কাটিয়ে দেয়। তাদের দু’জনের বাসা প্রায় কাছাকাছি। হেমন্ত এলে মোনার মনে যেন আনন্দ ধরে না। নানা রকম হৈ-হুল্লোড় আর আনন্দ করে কাটিয়ে দেয় হেমন্ত ঋতু। তাকে সঙ্গ দিতে শ্রাবণের কোনো জুড়ি নেই।
মোনা : এই আজকের আকাশে চাঁদটা অনেক সুন্দর তাই না ! কতো সুন্দর ঝকঝকে আলো দিচ্ছে…
শ্রাবণ : হুমমম। তবে তোমার রূপের আলো এর থেকেও বেশি তীব্রতর। যেখানে অন্ধকারে পথ চলতে কোনো আলো লাগবে না। তোর রূপের আলোই যথেষ্ট।
মোনা : থাক আর মিথ্যে বলতে হবে না। ওই দেখো জোনাকির নিভু নিভু আলো কতো সুন্দর লাগছে। একটা জোনাকি পোকা ধরে এনে দাওনা গো…
শ্রাবণ : হুমমম দিচ্ছি… এই নাও।
মোনা : ওয়াও কি দারুণ ! এই চলো না পুকুরে নৌকা ভাসিয়ে জলে পা ভিজিয়ে দু’জনে গল্প করি।
শ্রাবণ : হুমমম চলো…
মোনা : হুমমম। নৌকায় বসে তোমার কবিতা শুনবো।
শ্রাবণ : এতো কবিতা কোথায় পাবো তোমাকে ভাসাই !
মোনা : তুমি বললে এই কথা ! তুমিতো কবিতার কারিগর। মুহূর্তেই লিখতে পারো কোনো কবিতা।
শ্রাবণ : আজ কোনো কবিতা হবে না৷ তোমার কণ্ঠে গান শুনবো। অনেক গান শুনাবে…
মোনা : কিন্তু আমার গানের গলা তো ভালো নয়। শুনে তোমার খারাপ লাগবে। তারচেয়ে বরং তোমার কবিতা শুনি।
শ্রাবণ : না। আজকে তোমাকে গান শোনাতেই হবে।
মোনা : জোর করছো !
শ্রাবণ : হুমমম তাই…
মোনা : তাহলে এক কলি শোনাবো…
শ্রাবণ : পুরো গান শুনাতে হবে। তা না হলে আমার মন ভরবে না।
মোনা : কি একটা বিপদে ফেললে !
শ্রাবণ : হা হা হা…
মোনা : তোমার হাসি পাচ্ছে আমার বিপদে ?
শ্রাবণ : এই মুহূর্তে হাসি পাচ্ছে…
মোনা : হুমমম হাসো বেশি করে…
শ্রাবণ : তাহলে শুরু করো গান
মোনা : আমার গান শুনে হাসবে না কিন্তু।
শ্রাবণ : ওকে…
মোনা : ( সামিনা চৌধুরীর সেই বিখ্যাত গান শোনাতে যাচ্ছে শ্রাবণকে। যে গানের কথা…
‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে
জোনাকির আলো জ্বলে আর নেভে শালমহুয়ার বনে’…
এরপর পুরো গান শোনালো শ্রাবণকে। মোনার গানের গলা এতো বেশি সুন্দর কখনো বুঝতে পারেনি শ্রাবণ।)
শ্রাবণ : আমি পুরোই ফিদা হয়ে গেছি তোমার গান শুনে। এতো সুন্দর তোমার গানের গলা অথচ আমাকে গান শোনাতে তোমার এতো সংকোচ !
মোনা : থাক আর বলতে হবে না। আর কখনো গান শুনতে চেয়ে আমাকে বিপদে ফেলো না। আমি গান পারিনা। তবে গান শুনতে আমার খুব ভালো লাগে। সময় পেলেই গান শুনি।
শ্রাবণ : মাঝেমাঝে শুনালেই হবে…
মোনা : সে দেখা যাবে। এবার তোমার কবিতা শুনবো…
শ্রাবণ : না শোনালে হয় না…
মোনা : তোমার কবিতা না শুনলে রাতে আমার ঘুম-ই ধরবে না। শোনাও কবিতা…
শ্রাবণ : ওকে…শোনো তাহলে…
সব প্রেম পাঠিয়ে দিবো তোমার ঠিকানায়
যতনে রাখিও তুমি মনের সিংহাসনে।
এক পৃথিবী মায়াজালে আমাকে জড়াও
তৃষ্ণার্ত রজনীতে কাছে আসার বন্ধনে।
সব সুখ পাঠিয়ে দিবো তোমার ঠিকানায়
অনন্তকাল থেকো তুমি সদা হাসি-খুশি।
তুমি আছো তাই বেঁচে থাকার সুখ পাই,
প্রাণের মাঝে রেখে তোমায় ভীষণ ভালোবাসি।
সব কবিতা পাঠিয়ে দিবো তোমার ঠিকানায়
নিঝুম রাতে পড়ে নিও বেলকনিতে বসে।
এক আকাশ ভালো লাগায় আহ্লাদের ছলে
ছুঁয়ে যাবো তোমার কেশ চুপিসারে এসে।
সব সুর পাঠিয়ে দিবো তোমার ঠিকানায়
শুনে নিও একলা প্রহর মন খারাপের রাতে।
বিষণ্ণতা কেটে যাবে রাখিও বিশ্বাস,
জোনাকির নিভু আলোয় উঠবে তুমি মেতে।
সব ফুল পাঠিয়ে দিবো তোমার ঠিকানায়
গুঁজে নিও চুলের খোঁপায় গায়ে সুবাস মেখে।
তোমাতে আমি বিভোর হতে চাই,
ইশারায় শিস দিয়ে চোখেতে চোখ রেখে।
মোনা : অফুরন্ত মুগ্ধতা তোমার কবিতা ঘিরে। ভীষণ ভালোলাগার। সত্যি অনেক সুন্দর।
শ্রাবণ : আমার কবিতা যতোটা না সুন্দর, তার চেয়ে বেশি সুন্দর তোমার কথা বলার বচন ভঙ্গি। যা কবিতার চেয়েও বেশি সুন্দর শোনায়।
মোনা : আজকের মতো তাহলে চলো…
শ্রাবণ : এই চলো না এই সুন্দর সময়টাতে আমরা ধূমপান করি !
মোনা : এতক্ষণে কি বললে ! ধূমপান করবো !
শ্রাবণ : হুমমম শখ করে চলো…
মোনা : শখ করে তাই ধূমপান করবো !
শ্রাবণ : হুমমম প্লিজ !
মোনা : কি যে অদ্ভুত না তুমি ! কি একটা কথা বললে।
শ্রাবণ : আজকেই খালি…
মোনা : সাথে কি আনছো সিগারেট ?
শ্রাবণ : হুমমম আনছি…
মোনা : বের করো তাহলে…
শ্রাবণ : হুমমম। এই নাও…
মোনা : খালি আজকেই কিন্তু। আর কখনো এমন অনুরোধ করবে না। যা বলার আজকেই বলছো…
শ্রাবণ : ওকে ঠিক আছে। নাও এবার সিগারেট ঠোঁটে নিয়ে দিয়াশলাই দিয়ে জ্বালাও।
মোনা : ওকে দাও। ওহহহ পারছি না তো। কেমনে জ্বালবো ? তুমি জ্বালিয়ে দাও…
শ্রাবণ : হা হা হা… চেষ্টা করো পারবে…
মোনা : কো পারছি না তো…
শ্রাবণ : এইতো পারছো। এবার সিগারেট টানতে থাকো। ধোঁয়া বের করতে থাকো।
(কিন্তু একবার সিগারেট টান দিতে না দিতেই মোনা কাশি দিতে দিতে অস্থির। মোনার এমন অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে পেট ব্যথা করে ফেলেছে শ্রাবণ। কিছুতেই হাসি ধরে রাখতে পারছে না। এক পর্যায়ে শ্রাবণের হাসি থেমে যায়।
মোনা : আমি শেষ। সিগারেট এতো খারাপ জিনিস ! কাশি দিতে দিতে পেট আমার ব্যথা হয়ে গেছে। খুব অস্থির হয়ে গেছি।
শ্রাবণ : দাও সিগারেট দাও। দেখো কেমনে টানতে হয়…
মোনা : তুমিতো একটা নেশাখোর। তুমিতো পারবেই।
শ্রাবণ : এমন করে বলো না গো। আমি খুব কম ধূমপান করি। আজকে শখ করে সিগারেট সাথে আনছি তোমার সাথে ধূমপান করবো বলে। আজকের ঘটনাটা আমার অনেক বছর মনে থাকবে।
মোনা : কোন ঘটনা ?
শ্রাবণ : এইযে তোমার সিগারেট টানা…
মোনা : না একদম ভুলে যাবে। এক্ষুনি ভুলে যাবে তুমি।
শ্রাবণ : সে দেখা যাবে…
মোনা : আমার ভালো লাগছে না। খুব খারাপ লাগছে। বাসায় চলো…
শ্রাবণ : ওকে চলো….
(চলবে…)