হারানো হেমন্তের গন্ধ
লেখক: আয়াত আজাদ
হেমন্তের শহরে তখন কুয়াশার আস্ত পর্দা নামছে। বাতাসে গন্ধ শুকনো শালপাতার, দূরে কোনো অচেনা বংশীর সুর যেন আকাশে দুলছে, আর সেই সুরের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক—সানজিদ।
তার চোখে যেন ঘোর লেগেছে, মনের মধ্যে কেবলই বাজছে এক মুখের ছবি, এক কণ্ঠের প্রতিধ্বনি।
সবকিছু শুরু হয়েছিল এক বছর আগে।
সেদিন এক বইমেলায় গিয়েছিল সানজিদ। সে মানুষটা খুব বেশি মেলামেশা করে না, কিন্তু বইয়ের গন্ধ, অক্ষরের ছোঁয়া, আর মানুষের ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ কোনো অচেনা মায়া তার মনকে টেনে নেয়। ঠিক সেখানেই অপিকে প্রথম দেখে সে।
অপি দাঁড়িয়েছিল রবীন্দ্রসংগীতের একটা সিডি দোকানের পাশে, হাতে ধরা ছিল জীবনানন্দের কবিতার বই। হালকা নীল কামিজ, পাতলা সাদা ওড়না, কপালের মাঝখানে ছোট্ট একটা টিপ, আর মুখে মৃদু হাসি—এক অদ্ভুত শান্তি তার চোখে।
সানজিদ নিজের অজান্তেই তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ চোখে চোখ পড়ে যায়। অপি মৃদু হেসে বলে, “আপনিও কবিতা পড়েন?”
সানজিদ একটু হকচকিয়ে যায়, তারপর ধীরে হাসে, “হ্যাঁ… আসলে চেষ্টা করি।”
সেদিনের পর থেকে যেন কোনো অদৃশ্য সুতো বুনে যায় তাদের চারপাশে। একবার দেখা হয় নদীর ধারে, একবার কোনো পুরোনো ক্যাফেতে, একবার শহরের মফস্বলে মেঘলা আকাশের নিচে। তারা কথা বলে কবিতা নিয়ে, জীবন নিয়ে, স্বপ্ন নিয়ে।
অপি বলে, “জানো, আমি সবসময় ভেবেছি, আমরা আসলে ভীষণ একা। আমাদের ভেতরের কথা কেউ শুনতে পায় না।”
সানজিদ হাসে, “তুমি হয়তো কখনো বোঝো না, কেউ তোমার প্রতিটি কথা ধরে রাখছে…”
কয়েক মাসে সম্পর্কের সেই অজানা জায়গায় চলে যায় তারা—বন্ধুত্বের সীমানা পেরিয়ে যায়, সেই অদ্ভুত জায়গায়, যেখানে ভালোবাসা উচ্চারিত হয় না, কিন্তু বাতাসে মিশে থাকে।
একদিন, আকাশে ঘন মেঘ, ঝুম বৃষ্টি।
অপি ফোন করে বলল, “ চলো,বের হই। বৃষ্টিতে ভিজি।”
সানজিদ হেসে দৌড়ে বের হলো। তারা দুজনে ভিজে গেল, একসাথে, ছাতা ছাড়া, শহরের ফাঁকা রাস্তায়।
অপি বলল, “জীবনটা একদিন ফুরিয়ে যাবে, কিন্তু এমন দিন, এমন মুহূর্ত কি ফিরে পাওয়া যাবে?”
সানজিদ চুপ করে শুধু তার হাত ধরেছিল।
কিন্তু পৃথিবী কোনো গল্প নিখুঁত রাখে না।
একদিন অপি খবর দিল—তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
পরিবার ঠিক করেছে, বাবা-মায়ের ইচ্ছা, পাত্র বিদেশফেরত, চাকরি, গাড়ি, সব আছে। অপি তখন যেন দূরের মানুষ।
“তুমি কিছু বলবে না?” সানজিদ জিজ্ঞেস করল।
অপি চোখ নামিয়ে বলল, “বললে কী হবে? আমি কি পারি নিজের জীবন নিজের মতো গড়তে?”
বিয়ের আগের রাতে অপি একটা চিঠি লিখে রেখে যায়।
---
চিঠি:
“প্রিয় সানজিদ,
জানো, যখন তোমার পাশে থাকি, মনে হয় যেন আমি সম্পূর্ণ।
কিন্তু এই সমাজ, এই বাস্তবতা… আমরা তো শুধু অভিনয় করতে শিখি, জানো? আমার হয়তো সাহস ছিল না, বা তোমার ছিল না, অথবা আমাদের সময় ছিল না।
আমি জানি, তুমি মনে করে থাকবে, আমি হারিয়ে গেলাম। কিন্তু না, আমি থেকে যাবো। তোমার প্রতিটি কফির কাপে, প্রতিটি বইয়ের পাতায়, প্রতিটি হেমন্তের বাতাসে।
তুমি একদিন যখন নদীর পাড়ে হাঁটবে, আর হঠাৎ বুকের ভেতর হাহাকার টের পাবে, বুঝবে আমি পাশে আছি। আমি সেই অদেখা অনুভূতি, যেটা তুমি কোনোদিন ভুলতে পারবে না।
ভালো থেকো।
–তোমার অপি”
---
বিয়ের দিন, সানজিদ দূর থেকে অপিকে দেখল—লাল বেনারসী, সোনার গয়না, মুখে সেই একই শান্ত হাসি। একবার চোখ তুলে তাকাল অপি, মৃদু হাসল, চোখের কোণে এক বিন্দু জল, তারপর মুখ ঘুরিয়ে নিল।
শহরের বাতাসে সেদিন একটা নতুন শূন্যতা তৈরি হলো।
এখন,
সানজিদ তার কফির কাপ নিয়ে বারান্দায় বসে। আকাশে চাঁদ ঢেকে আছে মেঘে, হেমন্তের বাতাসে পাতা উড়ে আসে, একেকটা পাতার ভেতরে যেন অপির ফিসফিসানি মিশে আছে।
সে জানে, জীবন এগিয়ে যাবে, চাকরি, সংসার, সামাজিক বন্ধন—সব চলবে। কিন্তু তার ভেতরের সেই একটিমাত্র জায়গা, যেখানে অপির নাম লেখা, সেখানে আর কোনোদিন কেউ বসবে না।
রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে সানজিদ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, “অপি, তুমি তো জানো, আমি আজও তোমায় বুকে ধরে আছি…”
সেই মুহূর্তে দূরের বাতাসে কুয়াশার মধ্য দিয়ে হালকা এক গন্ধ ভেসে আসে—হেমন্তের, শালপাতার, আর এক হারানো ভালোবাসার।
Website: www.ichchashakti.com E-mail: ichchashaktipublication@gmail.com