গভীর শীতের সকালে যখন কুয়াশায় ঢেকে যেত চারপাশ, তখন মা ঘুম থেকে ডেকে তুলতেন। ছোট্ট আমি কিছুতেই উঠতে চাইতাম না। কিন্তু স্কুলের ভয়ে মাকে মানতেই হতো। স্কুল ড্রেস পরে, ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে, ছোট্ট টিফিন বক্স নিয়ে যখন স্কুলের পথে হাঁটতাম, তখন মনে হতো—এ এক অন্য জগৎ, যেখানে বন্ধুরা আর মজার দুনিয়া অপেক্ষা করছে।
আমাদের স্কুলের লাল রঙের বিল্ডিংটা এখনো চোখে ভাসে। সেই সিঁড়িতে বসে গল্প করা, মাঠে দৌড়াদৌড়ি, আর ক্লাসের মাঝখানে শিক্ষকের চোখ ফাঁকি দিয়ে কাগজের প্লেন ছোড়া—সবই যেন এক রঙিন স্মৃতির পটে আঁকা।
একবার ক্লাসে বাংলা স্যার একটা প্রশ্ন করেছিলেন, “বাংলা ভাষার জন্য শহীদদের নাম বলো।” আমার পাশে বসা রাজু দাঁড়িয়ে বলেছিল, “আমার নামও যোগ করে নিন, স্যার!” পুরো ক্লাস হেসে গড়াগড়ি খেয়েছিল। স্যারের রাগ ভেঙে গিয়েছিল, আর রাজু পেয়েছিল একটা বিশেষ ডাকনাম—“শহীদ রাজু।”
টিফিন টাইম ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে প্রিয় সময়। মাঠের এক কোণে সবাই মিলে বসে নিজের নিজের টিফিন ভাগ করে খেতাম। কারও মায়ের বানানো পরোটা, কারও বাসা থেকে আনা মিষ্টি, আর কারও ব্যাগে লুকিয়ে রাখা চকোলেট—সবাই মিলে ভাগ করে খাওয়া যেন বন্ধুত্বের আসল স্বাদ শিখিয়েছিল।
স্কুল জীবনের দুষ্টুমির কথা ভোলা সম্ভব নয়। একদিন বন্ধু রমজান ক্লাসের ফ্যান বন্ধ করে বলল, “স্যার, বাতাস আসছে না।” স্যার এসে সুইচ চালু করতেই ফ্যান থেকে একগাদা চক পড়ে গেল। স্যার কিছু বলার আগে আমরা সবাই দৌড়ে পালালাম।
পরীক্ষার ভয়ের দিনগুলোও এখন মজার স্মৃতি। পরীক্ষার আগে সবাই মিলে এক বেঞ্চে বসে মুখস্থ করতাম, কেউ কেউ আবার নোট পাস করার প্ল্যান করত। পরীক্ষার শেষে যে আনন্দ হতো, সেটা যেন জীবনের সব দুঃখ ভুলিয়ে দিত। স্কুলজীবন কেবল পড়াশোনা নয়, জীবনের পাঠও ছিল। বন্ধুত্বের মানে, শিক্ষককে শ্রদ্ধা করা, হার না মানার ইচ্ছা—সবকিছুই এই ছোট্ট জীবনে শিখেছি।
আজও স্কুলের সেই মাঠ, সেই ক্লাসরুম, আর বন্ধুদের মুখ মনে পড়লে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করি। সময় চলে গেছে, জীবন বদলেছে, কিন্তু স্কুলজীবনের স্মৃতিগুলো হৃদয়ের কোনো এক কোণে ঠিকই রয়ে গেছে।
স্কুলজীবন হলো জীবনের প্রথম অধ্যায়, যেখানে প্রতিটি স্মৃতি যেন একেকটি অমূল্য ধন, যা কখনোই হারায় না।
—–লেখকঃ মোঃ নাছিম প্রাং