প্রতিবেদক: মোঃ নূরনবী ইসলাম সুমন
কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী, প্রতিভাবান থিয়েটার কর্মী ও সংস্কৃতিকর্মী সোহাগী জাহান তনু হত্যার সাড়ে আট বছর পার হয়ে গেলেও এখনো বিচারের আলো দেখেনি এই নির্মম হত্যাকাণ্ড। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাসের ভেতরে তনুকে নির্মমভাবে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়। অথচ এত বছর পরও মূল অপরাধীরা অধরা, মামলার তদন্ত বারবার পরিবর্তন হলেও বিচার হয়নি, হয়নি প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি।
তনুর বাবা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারী মো. ইয়ার হোসেন ও মা আনোয়ারা বেগমের কণ্ঠে এখনো সেই একই প্রশ্ন— "আমাদের কলিজার টুকরা মেয়েটার হত্যাকারীরা কেন বিচারের বাইরে থাকবে?" কিন্তু তাদের আহ্বান বারবার উপেক্ষিত হয়েছে।
তদন্তের নামে প্রহসন
তনু হত্যার পরপরই দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ গড়ে ওঠে। গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র প্রতিবাদ দেখা গেলেও তদন্তের গতি ধীর হয়ে আসে কিছুদিন পরই। প্রথম ময়নাতদন্তে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ গোপন করার অভিযোগ ওঠে। পরে কবর থেকে মরদেহ তুলে দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত হলেও তাতেও ধর্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত না করে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করা হয়। ডিএনএ পরীক্ষায় একাধিক পুরুষের শুক্রাণু পাওয়া গেলেও অভিযুক্তদের শনাক্তের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে, তনু হত্যায় কুমিল্লা সেনানিবাসের কিছু প্রভাবশালী সেনা সদস্য জড়িত ছিল। বিশেষ করে এক উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী হিসেবে উঠে আসে। তবে সেনানিবাসের ভেতরে ঘটনা ঘটায় বিচারপ্রক্রিয়া বারবার ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ স্বজনদের।
সেনানিবাসের কালো অধ্যায়
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাক্ষী কুমিল্লা সেনানিবাস আজ তনু হত্যার কারণে কলঙ্কিত। যেখানে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মূল দায়িত্ব পালন করা হয়, সেই জায়গা থেকে তনুর লাশ উদ্ধারের বিষয়টি পুরো জাতির জন্য ছিল লজ্জার। এতবড় ঘটনায় এখনো দোষীদের শাস্তি না হওয়া বিচারহীনতার নগ্ন দৃষ্টান্ত।
তনুর মা-বাবার আকুতি
তনুর মা আনোয়ারা বেগম একাধিকবার বলেছেন, "আমরা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নই, কিন্তু যারা অপরাধ করেছে, তারা কেন আইনের আওতায় আসবে না? আমরা কি আমাদের মেয়ের ন্যায়বিচার পাব না?"
কুমিল্লা সেনানিবাসের প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া, তদন্ত ধীরগতিতে পরিচালিত হওয়া এবং বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে জনমনে তীব্র ক্ষোভ রয়েছে।
বিচারহীনতা ও রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, তনু হত্যার বিচারহীনতা এটাই প্রমাণ করে যে, দেশের বিচারব্যবস্থা প্রভাবশালীদের কাছে অসহায়। বারবার তদন্ত কর্মকর্তাদের পরিবর্তন, সিআইডির তদন্তের দীর্ঘসূত্রিতা এবং সরকার ও সেনাবাহিনীর নীরবতা এই হত্যাকাণ্ডের বিচার পাওয়া আরও কঠিন করে তুলেছে। তনু হত্যার পর দেশে বহু আন্দোলন-প্রতিবাদ হলেও, সময়ের ব্যবধানে বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে গেছে। প্রশ্ন উঠছে— আমরা কি তনুর নামও ভুলে যাব?
বিচারের অপেক্ষায় দেশবাসী
এখনো তনুর মা-বাবা, পরিবার, শুভাকাঙ্ক্ষী, এবং দেশের সাধারণ জনগণ এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানিয়ে আসছে। নতুন সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের আওতায় না আনে, তাহলে বিচারহীনতার এই অপসংস্কৃতি চলতেই থাকবে।
সোহাগী জাহান তনুর জীবনের শেষ গান ছিল—
"অশ্রু দিয়ে লেখা এ গান যেন ভুলে যেয়ো না..."
তনুকে কি আমরা ভুলে যাব, নাকি তার জন্য ন্যায়বিচার আদায়ে সোচ্চার হব?
Website: www.ichchashakti.com E-mail: ichchashaktipublication@gmail.com