দিনটি ছিল সাধারণ দিনের মতোই, সারাদিনের দৌড়ঝাঁপ আর ব্যস্ততার পর কখনো নিজেকে সামলে কোথাও বসা হয়ে ওঠে না। সেদিন আসরের নামাজ শেষে মসজিদের পুকুরপাড়ে দাঁড়ালাম, প্রভাবশালী সূর্যের তীব্রতা কমে এসেছে। হলুদ বর্ণ ধারণ করায় কুসুমের মতো দেখাচ্ছে।
অনিশ্চিত এই জীবনে কখনো আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি লক্ষ্য করা হয়নি যে মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের কত নেয়ামতে ভরপুর করে রেখেছেন। আল্লাহর সৃষ্টি কত নিখুঁত। সৌন্দর্যে ভরা নেয়ামতের প্রতি শুকরিয়ার দৃষ্টি দেওয়ার ফুরসতটুকু হয়ে ওঠে না, অথচ আমরা টেনশন আর রিজিক সন্ধানের দৌড়ঝাঁপে ভুলে যাই আমাদের জীবন সুতো একজনের কাছে। আমাদের রিজিক আমাদের হায়াত নির্দিষ্ট।
আমি বসে পড়লাম পুকুরপাড়ে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। বিশাল সূর্য ধীরে ধীরে পানির মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে। খুব ভোরে নীড় ছাড়া পাখিরা গন্তব্যে ফিরছে। এলাকার এক চাচাকে লক্ষ্য করলাম পুকুরে নামছেন। কর্দমাক্ত শরীর ধৌত করেছিলেন। সাথে ওযুও সেরে নিলেন। বুঝাই যাচ্ছিল এখন তিনি আসর পড়বেন। মাথা উঁচু করে একবার জেনে নিলেন ওয়াক্ত আছে কি না।
চাচার সাথে বাক্যবিনিময় চলছিলো। কথা ফাঁকে জানতে চাইলাম, “চাচা, এইযে কাক ডাকা ভোরে মাঠে যান, দিনভর পরিশ্রম করেন, ক্লান্তি লাগে না?” তিনি হেসে বললেন, “ক্লান্তি তো লাগে বাবা, কিন্তু কাজ শেষে এই গোধূলি যখন দেখি, মনে হয় জীবনের সব কষ্টই সার্থক। মাঠে ফসল ফলানোর সুখই তো আমার জীবন। আল্লাহ আমাকে যতটুকু দিয়েছেন, তাতেই আমি সন্তুষ্ট। ক্লান্তি থাকলেও মনে শান্তি আছে।”
চাচা চলে গেলেন। আমি আরো কিছু সময় বসে রইলাম সূর্যাস্ত দেখে মনে হচ্ছিলো বিশাল সূর্যকে গিলে নিচ্ছে সামান্য জল। এরই মাঝে কানে মুয়াজ্জিনের সূর ভেসে আসে। মাগরিবের আজান হচ্ছে। নামাজ শেষে আবার পুকুরপাড়ে আসি। কিন্তু আগের পরিবেশ এখন আর নেই, সূর্য ডুবে গেছে। আকাশে তারার মিটিমিটি আলো ফুটে উঠছে। মনে হলো, আল্লাহর সৃষ্ট এই প্রকৃতি আমাদের প্রতি তাঁর দয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়। দিনের শেষে আমাদের ক্লান্তি দূর করার জন্যই যেন তিনি এই শান্ত সন্ধ্যাকে পাঠান।
এই সূর্যাস্তের আহ্বান আমাকে শিখিয়েছে—জীবনের প্রতিটি কষ্টের পরে আল্লাহর কাছে সান্ত্বনা পাওয়া যায়। এই দুনিয়ার সবকিছু ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু আল্লাহর দেওয়া প্রশান্তি চিরস্থায়ী। রাত গভীর হলো, কিন্তু আমার মন এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে উঠল। হয়তো এটাই জীবনের আসল শিক্ষা—”শান্তি খুঁজে পেতে হলে, আগে আল্লাহর দিকে ফিরে যেতে হয়।”