আমার একঘেয়ে জীবনের সাথে প্রতিদিনের কর্ম সম্পাদন করে যাচ্ছি। আজও রোজা রেখে টিউশনে গেলাম, শরীরটা ক্লান্ত তাই ছাত্রীকে বললাম, আজ একটু মনোযোগ দাও, নাহলে পড়াতে পারব না, কারণ শরীরটা খুব ই ক্লান্ত। সে ভারী দুষ্টু, পড়ালেখাতে তার মন নেই বললেই চলে। বাবা মা আর আমি জোর করে পড়ায় মতো মনে হয় অনেক সময়। তবে তার একটি সুন্দর নাম রয়েছে, “সুচিত্রা”। সে মাত্র কলেজ জীবনে পা রেখেছে অর্থাৎ ফার্স্ট ইয়ার। সে আমাকে অনেক পছন্দ করে, তা আমি বুঝতে পারি সব সময়, তবে তাকে লাই দেয় না কখনোই। মেয়েটার যেমনি কন্ঠ, তেমনি তার চোখের ধার। তার কাজল কালো চোখ যেন শত নারীর উৎকৃষ্ট চোখ। তার কিন্নরী কন্ঠ যেন শত গায়ককে হার মানাবে। সে মাঝে মাঝে আমাকে গান শোনাই, মনে মনে আমার তার প্রতি ভালো লাগা বৃদ্ধি পেতে থাকলেও কিন্তু তা প্রকাশ করি না কখনোই কারণ কে জানতে পারলে মাথায় চড়ে বসবে। তার চেহারা যেন সাদা তুলোর মত। চুল যেন স্তরে স্তরে সাজানো, বাহারি রকমের পাক দেওয়া তার চুলে, “সুন্দর” যেন আকাশচুম্বি। এভাবে তাকে বর্ণনা করার কারণে ভাববেন না যে আমি তার প্রেমে পড়েছি, তবে এমন মেয়েকে কে এড়িয়ে যেতে পারে বলুন, যার সৌন্দর্যের শেষ নেই। তবে আমার যে তার প্রতি ভালো লাগা কাজ করতো, তা অস্বীকার করার মত কিছু নেই। অন্য সময় হলে তার প্রেমে নিশ্চয়ই পড়ে যেতাম, তবে আমি যে তার শিক্ষক এ কথা আমাকে বাধা দেয়। সেই ছোটখাটো ন্যাকামি করতো যা আমার খুবই ভালো লাগতো। মাঝে মাঝে চকলেটের আবদার করতো তা মিটাতে আমি কখনোই কৃপণতা করতাম না। তখন আমি অনার্স তৃতীয় বর্ষে ছিলাম।
এভাবে ঘুরতে ঘুরতে জীবনের একটি লক্ষ্য অর্জনের পিছনে লেগে পড়লাম। আর লক্ষ টা হল ভালো একটি চাকরি পাওয়া, আমাদের দেশে বিসিএস যেন একটি সোনার চাকরি আমিও লেগে পড়লাম তার পেছনে। গাধার মতো পরিশ্রম করে প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। প্রথম পরীক্ষা দিলাম, হতাশা জনক। দ্বিতীয়বারও দিলাম পরীক্ষা, তখন যেন নিজের শক্তিটা আর খুঁজে পাচ্ছি না এবারও হতাশাজনক রেজাল্ট। মনে মনে ভাবতে লাগলাম স্বনামধন্য একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ে দুবারে যদি বিসিএস পাস করতে না পারি, নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল। তবে সৃষ্টিকর্তার যে পরিকল্পনা ভিন্ন রকম তা বুঝতে পারি ঠিক একই বছরে। আমি একটি সরকারি চাকরি পেয়ে গেছি, মাকে জানানো হলো আগে মা যেন খুশিতে আত্মহারা। এভাবে জানতে থাকলো আমার বন্ধুবান্ধবরা সহ অনেকেই। তবে আমিও খুশি কিন্তু মনের মধ্যে কোন এক কোণে যেন সুপ্ত কষ্টগুলো বারবার নাড়া দিচ্ছে। বিসিএস নিয়ে যে স্বপ্নটা দেখা তা আর হলো কই। ভাবতে লাগলাম সব আশা তো আর পূরণ হয় না। কিছু আশা অপূর্ণ থাক, হয়তো জীবন এমনই। আমিও মেতে উঠলাম উৎসবে, নতুন চাকরির। এখন জীবনে কিছুটা প্রশান্তির হাওয়া বইছে যেন একঘেয়ে জীবনকে বিদায় দিয়ে এসেছি আর হ্যাঁ সাথে পূর্ণতা পেল আর একটি বিষয় আমার প্রেমের পরিসমাপ্তি এলো, বিয়ের মাধ্যমে। আরে আপনাদের তো বলাই হলো না আমার সেই অব্যক্ত প্রেম, কারণ মানুষ সফলতা না পেলে তার কাহিনী শুনতে কেউ আগ্রহী হয় না। যেহেতু আমার একটা গ্রাউন্ড তৈরি হয়েছে তবে আপনাদের শোনার অধিকার পাই কি তবে? আচ্ছা চলুন বলি সেই অব্যক্ত প্রেমের কথা। তার পূর্বে আপনাদের বলবো না সে কে? যাকে আমি বিয়ে করেছি।
তখন আমি অনার্স শেষ করে মাস্টার্সের শুরুর দিকে। ঠিক একইভাবে একদিন টিউশনে যাচ্ছিলাম, নদীর কিনারা যেখানে শেষ ঐরকম নীল আকাশের নিচে এক বট গাছের সাথে দেখতে পাই নীল শাড়িতে এক রমণীকে। প্রথম দৃষ্টিতে আকর্ষণ কেড়ে নিবে এমনই এক রমণী, হরিণী চোখ সাদা তুলার মতো চেহারা, রক্তিম ঠোঁট আর সোজা সাপটা চুল। মুখ যেন চওড়া, মায়ায় তুলনাহীন। তার কাছে গিয়ে কথা বলার খুব ইচ্ছে ছিল,সাহসে কুলায়নি। তার পিছু পিছু চলতে থাকলাম এভাবে করে তার ঠিকানাটা চিনতে অসুবিধা হলো না। বেশ কয়েকদিন তাকে চোখে চোখে রাখলাম, আর খবর নিয়ে দেখলাম তার কোন প্রিয়জন নেই। যা আমার হৃদয়ের জন্য প্রশান্তির এক নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। কিছুদিন পরে রাস্তায় আমাদের খুব কাছ থেকে দেখা হল, কারণ সেসময় সে একটি রিক্সার সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়েছে, আমি তাকে ধরে তুললাম তার অনেকটাই হাত কেটে গিয়েছে। আমি তাকে নিয়ে আরেকটি রিক্সায় উঠে হসপিটালে গেলাম। সত্যি বলতে এমন একটি সুযোগ পেলাম তার সাথে কথা বলার, যা আমাকে তার সাথে খুব কাছ থেকে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। এই দিনের পর থেকে সে আমার প্রতি একটি সফট কর্ণার তৈরি করে নিল। সে আমাকে প্রতিদান স্বরূপ একদিন তার বাসায় দাওয়াত করল, তার পরিবারের সাথে দেখা হল, যথেষ্ট মার্জিত রুচির। আমাদের বন্ধুত্বটা যেন হয়েই গেল। এখন কেমন জানি তাকে ছাড়া একটা দিনও কাটতে চায় না, তার সাথে প্রত্যেকটা দিন ফোনে কথা হয়। একটা জিনিস অনুভব করলাম সে আমার সাথে কথা বলতে বিরক্ত বোধ করে না কখনোই। আমি আর তর সইতে পারলাম না, চিন্তা করলাম তাকে আমার পছন্দের কথা জানাবো। একদিন ঘটা করে তাকে পার্ক নিয়ে একটি ফুল দিয়ে প্রপোজ করলাম, সে প্রথমে কি বলবে বুঝতে পারল না। পরে কিছু না বলে বাসায় চলে গেল। পরদিন রাত্রে ফোন দিয়ে আমার সাথে দেখা করতে বলল। আমি ভয়ে ছিলাম কি না কি বলে আবার, দেখা হওয়ার সাথে সাথে সে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি যেন হারিয়ে গেলাম আমার নিজের ভিতরেই। তার সাথে আমার প্রেমের সম্পর্কটা যেন ছিল আমার বেঁচে থাকার এক উৎস। তাকে ছাড়া আমার একটা দিনও কাটে না। একদিন আমরা পার্কে ঘুরতে গেলাম, তাকে রেখে খাবার আনতে গিয়েছি দোকান থেকে।
সে আমার দিকে এগিয়ে যেতে রাস্তা পার হচ্ছিল হঠাৎ করে আমার পৃথিবীতে যেন থমকে গেল, দেখলাম সে হাওয়ায় ভাসছে, মাটিতে পড়ার সাথে সাথে যেন রক্তে রাস্তা ভিজে গেল। আমি জ্ঞান হারালাম পরে নিজেকে আবিষ্কার করলাম হাসপাতালে, আশেপাশে মানুষকে জিজ্ঞেস করতে থাকলাম, আমার সাথের জন কয়? তারা বলল তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। আর হ্যাঁ আপনাদের তো তার নামই বলা হলো না, আমার প্রিয়তমা “নীলা”। আমার অসুস্থ শরীর নিয়ে তাকে আইসিইউতে দেখতে গেলাম, তার শরীরের কোন নড়াচড়া নেই। তিন চারদিন ধরে তার পাশে বসে আছি, একটুও কথা বলেনি আমার নীলা আমার সাথে। আমি কেন জানি তার ভেতরের দীর্ঘশ্বাস দেখতে পাচ্ছি, যেন তার সাথে কথা বলতে পারছি। এক সপ্তাহ ধরে তার একই অবস্থা তবুও সে আমার সাথে কথা বলছে। হঠাৎ একদিন তার ব্লাড প্রেসার কমে যাচ্ছে তাই দ্রুত ডাক্তারকে ডাক দিলাম, ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করছে। কল্পনায় দেখছি, আমার নীলা বলছে আমি আর পারছি না। আমি তার সাথে কথা বলে যাচ্ছি তাকে কিছুতেই বুঝাতে পারছি না “যেন তুমি থেকে যাও”। ডাক্তার অনেক জোরাজোরি করছে আমি বলছি তখন তাদের, সে আর থাকতে চাচ্ছে না, এবার সে বিদায় নিবে। অতঃপর সে রঙ্গিন দুনিয়াকে বিদায় জানিয়ে দিল আর সাথে একা করে গেলো আমাকে।
এই দুঃখ নিয়ে আমি প্রতিদিন তার কবরের জিয়ারত করি আর স্বাভাবিক জীবনের ফেরার চেষ্টা করছি, হাজার বার, লক্ষ বার কিন্তু তাকে যে ভুলতে পারছিনা। আমাদের সম্পর্কটা মাত্র ছয় মাসের, কিন্তু মনে হয় যেন ছয় যুগ পার করে এসেছি একসাথে। মাস্টার্সের শেষ দু মাস বাকি আছে পুরনো ছাত্রীকে আবার পড়াতে গেলাম এবার সে ইন্টারমিডিয়েট ফাইনাল দেবে। সে আমার দুঃখ দেখে যেন মন থেকে আর সহ্য করতে পারছে না। সে সর্বদা আমাকে সান্তনা দিতে থাকে। আস্তে আস্তে সে আমার পরম বন্ধুতে পরিণত হলো, আমি যেন আমার মনের সব অব্যক্ত কথা তার সাথে ভাগাভাগি করতে লাগলাম। এক সময় গিয়ে এতটাই কাছের হয়ে গেলাম যে সে আমাকে যে কোন সময় জড়িয়ে ধরে কান্না করে, আমি অসুস্থ হলে সেবা করে আর দুহাত ধরে হাঁটতে থাকে। আজ সে অনার্সের ছাত্রী সে আমাকে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করে দিল। এত সুন্দরী মেয়েকে কি না করা যায় বলুন? প্রচলিত একটা কথা আছে মানুষ প্রেমে একবারই পড়ে। তবে আমার ক্ষেত্রেও সত্য ছিল সেটাই, তবে আমি যে কখন দ্বিতীয় বার প্রেমে পড়লাম, তা কোনভাবেই টের পাইনি। এটা ছিল আমার সত্যিকারের দ্বিতীয় প্রেম। সুচিত্রা যেন দ্বিতীয়বারের মতো আমার জীবনকে চিত্রায়ন করল। আমি ফিরে পেলাম দ্বিতীয় জীবন আজ সে আমার স্ত্রী আর পরম ভালোবাসার মানুষ। কিছু কিছু মানুষ আমাদের জীবনে আশির্বাদ স্বরূপ। যা খোদাতালা নিজে নির্ধারণ করেন আর কষ্টের সময় তারাই হয় আমাদের সর্বোচ্চ খুটি। সুচিত্রা তুমি আমার জীবন আর আমার হৃদয়ের সবটুকু জুড়ে তুমি। আজ আমি বলতে নিজেকে খুঁজে পাই না আর, তোমার মধ্যে যেন আমি নিজেকে দেখতে পাই। নীলা আজ তোমাকে হয়তো খুঁজে পাই না, তবে তুমি বেঁচে আছো নিশ্চয়ই। এইতো বেশ তোমাকে নিয়েই জীবন কাটছে সুচিত্রা হয়ে।