আজ ৫ই অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস। জীবনে চলে যায় কত দিবস, হারিয়ে যায় কত বাসর। কেবা রাখে তাহার খোঁজ…
আমার জীবনে অনেক শিক্ষক দিবস পেরিয়ে গেছে কিন্তু কখনো শিক্ষকদের নিয়ে অনুভূতি প্রকাশ করা হয়ে উঠেনি। চাইলেই কি সকল অনুভূতি প্রকাশ করা সম্ভব হয়! শিক্ষকেরা বদলে দেয় আমাদের জীবন, তাদের কথার ভঙ্গিতে পরিবর্তন হয় জীবনের গন্তব্য। তাঁদের কিছু কথা আমাদের ভীষণ ভাবে আঘাতও করে; যা পরবর্তীতে সফলতা হয়ে ফিরে আসে। শিক্ষকদের কাছে প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রী সদ্য অঙ্কুরিত চারাগাছের মতো। বিদ্যালয় নামক বাগানে সেই চারাগাছ রোপন করে মা-বাবা আর সেই চারাগাছকে যত্ন, ভালোবাসা, তিরস্কার, জ্ঞান সবকিছু দিয়ে বড় করে তোলে শিক্ষক নামক মালি।
মা-বাবা সন্তানকে জন্মদান করে ঠিকই কিন্তু তাকে শিক্ষার্থী হিসাবে গড়ে তোলে একজন শিক্ষক। বাগানের কোনো গাছ যেমন পরিচর্যাকারী মালির ঋণ কখনো শোধ করতে পারবে না তেমনি কোনো শিক্ষার্থীও তার শিক্ষকের ঋণ শোধ করার ক্ষমতা রাখে না। এই ছোট্ট জীবনে আমি অনেক শিক্ষকের সহচর্য পেয়েছি। কেননা কোনো বিদ্যালয়েই স্থায়ীভাবে পড়াশোনা করিনি। আমার শিক্ষাজীবনের ১০বছরে ৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি। আমার এলাকার প্রায় প্রতিটা শিক্ষক আমাকে চেনেন। শুধু চেনেন বললে ভুল হবে খুব ভালো করেই চেনেন।
আমার সর্বশেষ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল “লালমনিরহাট সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়”। বছরের মাঝামাঝি সময়ে টিসি নিয়ে গার্লসে ভর্তি হইলাম। বেশ উত্তেজনা কাজ করছিল কেননা আমার বাড়ি ছিল রংপুর জেলায় বাড়ির বাইরে থেকে পড়াশোনা করব। অন্যরকম একটা অনুভূতি কাজ করছিল।
যখন আমি ক্লাস করা শুরু করলাম ধীরে ধীরে নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে হচ্ছিল। সবাই পূর্ব পরিচিত বেশ কিছু গ্রুপ ছিল নিজেদের ভিতর। একাকিত্বটা একসময় ভীষণ ভাবে জেঁকে বসল। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম, নাহ এখানে আর থাকব না। যখন আমার মন আর মস্তিষ্ক দুটোই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল তখন বলা চলে একটা ম্যাজিক হয়ে গেল। নবম শ্রেণীতে আমাদের ক্লাশ টিচার ছিলেন সোহাগ স্যার। একজন শিক্ষকও শিক্ষার্থীদের সত্যিকার অর্থেই বন্ধু হতে পারে তাঁকে না দেখলে কোনোদিন বুঝতে পারতাম না। রংপুরে ফিরে আসব সিদ্ধান্ত নিয়েও আমি থেকে গেলাম লালমনিরহাটে। প্রতিদিন একটা লোভ কাজ করত স্যারের পরের দিনের ক্লাসটা হয়তো আরও মজাদার হবে। একজন মজার শিক্ষকের আনন্দময় ক্লাসকে ভালোবেসে আটকে গেলাম মায়ায়। একসময় বিদ্যালয়টাকেও ভালো লাগতে শুরু করলো।
স্যার আমাদের গনিত আর রসায়ন ক্লাস নিত।যদিও স্যার সেখানে গণিতের শিক্ষক হিসাবে নয় বরং ফিজিক্সের শিক্ষক হিসাবে ছিল। তবুও তিনি এত ভালো গনিত পড়াতো যে আমি বুঝতেই পারিনি তিনি কিসের শিক্ষক! আমার এটা মনে হয় যে, প্রতিটা ক্লাসে অন্যান্য শিক্ষকদের তুলনায় শ্রেণী শিক্ষকের ভুমিকা অনেক বেশি। স্যার সবসময় বলতেন, জীবনে ভালো ছাত্রী নয় বরং একজন ভালো মানুষ হওয়ার অনুশীলন করো। চাইলেই তো একজন ভালো শিক্ষার্থী হতে পারবে কিন্তু ভালো মানুষ হওয়ার অনুশীলন করতে হবে। দিনশেষে যেন বলতে পারো আমি আমার জায়গা থেকে সৎ, আমি একজন ভালো মানুষ। স্যার হয়ত এখনো জানেন না, তার কথাগুলো আমার দু-বছরের পরিকল্পনা বদলে দিয়েছিল। রংপুরে না ফিরে লালমনিরহাটেই থেকে গিয়েছিলাম। তার অনুপ্রেরণামূলক কথাগুলো সারাজীবন অনুপ্রেরণা দিয়ে যাবে। শুধুমাত্র একজন শিক্ষকের জন্যই অচেনা পরিচিত পরিবেশকে আপন করতে পেরেছিলাম। যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে আরও অনেক মহৎ প্রাণ আইয়ুব স্যার, জাকারিয়া স্যার, রানা স্যার, সুব্রতলাল স্যার, রাশেদ স্যার, মজিদ স্যার, মোর্শেদুল স্যার, রেজওয়ানা ম্যাম প্রমুখ শিক্ষকদের সহচর্য পেয়েছি।
গার্লসে আমার প্রথম পথপ্রদর্শক সোহাগ স্যার।দশম শ্রেণী যখন উঠি তখন খুব মিস করতাম নবম শ্রেণী।তখন আবারও নতুন ম্যাজিক ঘটে।আমার এখন অব্দি জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কেটেছে লালমনিরহাট গার্লসে। সেখানেই দেখা হয়েছে দু-জন শ্রেষ্ঠ ম্যাজিশিয়ান সোহাগ স্যার এবং সুব্রত স্যার। কখনো অনুভুতিগুলো ব্যক্ত করা হয়নি। যতবার ব্যক্ত করতে যাই শব্দের উপযুক্ততা খুঁজে পাইনা। তবুও ভাঙা ভাঙা শব্দে অনুভূতি প্রকাশের চেষ্টা। সকল শিক্ষকদের জানাই শিক্ষক দিবসের শুভেচ্ছা ও বিনম্র শ্রদ্ধা। আপনারা যুগান্তর ধরে আলোকবর্তিকা হয়ে আসুন প্রতিটা শিক্ষার্থীর জীবনে। এভাবেই মালি হয়ে বাঁচিয়ে তুলুন মরণাপন্ন অঙ্কুরিত বীজগুলোকে।
লেখাতে কোনো ভুলত্রুটি হয়ে গেলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।ছোট্ট হৃদয়ের অনুভুতি প্রকাশের দীর্ঘ প্রয়াস।
লেখকঃ
মুমতাহিনা। ক্ষণিকের মায়া (ছদ্মনাম)।