মাসুদ রানা
কৃষাণ আলী সকাল ছয়টায় উঠে পড়েন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে প্রতিদিনের মতো আজও তিনি রওনা দিলেন শহরের নির্মাণস্থলের দিকে। বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই হলেও তার দেহে বয়সের ছাপ পড়েনি, কিন্তু চোখে জমেছে ক্লান্তির ছায়া। এই শহরে তিনি এসেছেন বহু বছর আগে, পেটের দায়ে। গ্রামের ফসলি জমি নদী ভাঙনে হারিয়ে যাওয়ার পর শুরু হয় তার শ্রমিকজীবন।
নির্মাণ সাইটে কাজ করার মানে শুধু ইট-সিমেন্টের খেলা নয়, জীবন ও মৃত্যুর প্রতিনিয়ত খেলা। একদিন হঠাৎ একটি বাঁধ ভেঙে পড়ে তার সহকর্মী রমজান আহত হলেন, অথচ মালিক পক্ষ চিকিৎসার ব্যয় বহন করল না। কৃষাণ আলী সেই দিনই প্রথমবার শুনলেন “শ্রমিকের অধিকার” কথাটি। জানতে পারলেন, শ্রমিকদেরও ন্যায্য দাবি থাকে, সেগুলো আইনসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু অধিকাংশ শ্রমিকই জানেন না বা জানলেও ভয় পান মুখ খুলতে।
কৃষাণের ভিতরের রূপান্তর
কৃষাণ ভাবলেন, “আমরাই যদি চুপ করে থাকি, তাহলে আমাদের দুঃখ-কষ্ট কে দেখবে?” সেই থেকে তিনি খোঁজ নিতে শুরু করলেন শ্রমিক ইউনিয়ন সম্পর্কে। কয়েকজন সচেতন সহকর্মীর সঙ্গে আলাপ করে জানলেন, শ্রমিকদের জন্য সরকার নির্ধারিত কিছু নীতিমালা আছে, যার মধ্যে আছে:
নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি
দৈনিক ও সাপ্তাহিক ছুটি
নিরাপদ কর্মপরিবেশ
শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা ও বীমা
দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ
গর্ভবতী নারীকর্মীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব নিয়মের কোনো প্রয়োগ নেই। মালিকপক্ষ সুযোগ বুঝে শ্রমিকদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে। কৃষাণের মনে হলো, তাদের অধিকার ফিরিয়ে আনতে হলে সংগঠিত হতে হবে।
সংগঠনের পথচলা
কৃষাণ আলী কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে গড়ে তুললেন “মজুরি সংগ্রাম কমিটি”। তারা কর্মস্থলে নিয়মিত সভা করতে শুরু করলেন, শ্রমিকদের জানাতে লাগলেন কী তাদের প্রাপ্য, এবং কিভাবে তা দাবি করতে হয়। প্রাথমিকভাবে অনেকেই ভয় পেলেন, “মালিক যদি কাজ থেকে বের করে দেয়?” কৃষাণ বললেন, “ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রেখেছে বলেই তো আমাদের এই অবস্থা! আমাদের সাহস না করলে আমাদের বাচ্চারা অভুক্ত থাকবে, ভবিষ্যৎ থাকবে না।”
ধীরে ধীরে সাহসী শ্রমিকরা সংগঠনে যুক্ত হলেন। তারা মালিকপক্ষের সঙ্গে প্রথম দফা বৈঠকে বসেন এবং তুলে ধরেন তাদের দাবিসমূহ:
প্রথমে মালিকপক্ষ এসব দাবিকে তুচ্ছ করে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু কৃষাণ ও তার সহকর্মীরা জানতেন, এখন পিছু হটলে আর কোনোদিন তারা সম্মান পাবে না। তারা কাজ বন্ধ রাখার মতো সাহসী পদক্ষেপ নেন—ধর্মঘট।
ধর্মঘটের প্রতিক্রিয়া ও অর্জন
শহরের বড় নির্মাণ প্রকল্প থমকে গেল। সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ল খবর, “শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য দাবিতে ধর্মঘটে।” সুশীল সমাজ ও কিছু মানবাধিকার সংগঠন পাশে দাঁড়াল। শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিনিধি এসে মধ্যস্থতা করল।
শেষ পর্যন্ত, শ্রমিকদের অধিকাংশ দাবি মেনে নেওয়া হয়। কৃষাণ আলী বুঝলেন, “সংগঠিত হলে, সঠিক দাবি নিয়ে এগোলে, জয় সম্ভব।”
শ্রমিকের মূল্য
আজ ১লা মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। কৃষাণ আলীকে স্থানীয় একটি এনজিও সংস্থা “শ্রমিক নেতা সম্মাননা” প্রদান করেছে। তার চোখে জল, মনে গর্ব—নিজের জীবনে তিনি হয়তো বিলাসিতা পাননি, কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছু রেখে যেতে পেরেছেন।
তিনি বক্তৃতায় বললেন:
“আমরা শ্রমিকরা শুধু কাজের যন্ত্র নই। আমাদেরও পরিবার আছে, স্বপ্ন আছে। আমাদের ঘামে দেশ গড়ে ওঠে, ভবন দাঁড়ায়, রাস্তা তৈরি হয়, শিল্প বিকশিত হয়। তাই আমাদের ন্যায্য দাবি মানা মানে শুধু নীতি পালন নয়, এটা ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা।”
উপসংহার
শ্রমিকের অধিকার মানে কেবল আর্থিক সুবিধা নয়, এটি একধরনের মানবিক সম্মান। শ্রমিকের জীবনকে নিরাপদ রাখা, তার শ্রমের উপযুক্ত মূল্য দেওয়া, বিশ্রামের সুযোগ দেওয়া এবং প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নৈতিক দায়িত্ব।
এই গল্পে কৃষাণ আলীর জীবনের মধ্য দিয়ে আমরা দেখেছি, অধিকার কখনো নিজে থেকে আসে না, তা অর্জন করতে হয়—সচেতনতা, সাহস এবং ঐক্যের মাধ্যমে।