ছেলেটার মাথায় হাত রাখতেই রক্তে চুপ চুপ হয়ে গেল ফারিয়ার জোসনা-ধোয়া হাত। চমকে উঠলো সে নিজের হাতের দিকে চেয়ে। ভাষা হারিয়ে ফেলল। খুব ভয় চোখে মুখে। হৃদয়ে দ্বিধার গুঞ্জরণ। মৃত্যুর কোলে মাথা রাখা অপরিচিত ছেলেটাকে একলা ফেলে যাওয়া কতোটা যুক্তিসঙ্গত—এ ভাবনার ঘোরে নির্বিকার মত্ত সে। চারিপাশের অবস্থা মন্দ। এদেশের মানুষগুলো আবেগপ্রবণ, স্বার্থসিদ্ধির জন্য জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত, ছোট ঘটনাকে ইস্যু করে বড় ফল পেতে এদের প্রতিজ্ঞা আকাশের মতই বড়। বিশাল। যদি সেই ঘটনাটা হয় একটা মেয়ের মৃত্যুমুখী পথিকের শিওরে বসে থাকা কে কেন্দ্র করে,তাহলে তো বলাই বাহুল্য—মেয়ের জীবনটা কোন পথে যেতে পারে, তার পবিত্র জীবনের রোদ-মাখা উঠোনে বইতে পারে কতো সহস্র অপবাদ ও কটুবাক্যের ধুলোঝর, তা আর বলতে হয় না। “ভালো হবে, আস্তে করে সরে যাওয়া। এতেই নিরাপদ নিজের মান ও সম্মানের” হাঁটু গেড়ে বসে ভাবছে ফারিয়া। যেই ভাবা সেই কাজ। সে উঠে দাঁড়ালো। পথ ধরল চলে যাওয়ার। তার হাঁটার গতিতে স্পষ্ট দ্বিধার ছাপ।
“পানি পানি” ভাঙ্গা আওয়াজের শব্দ দুটো পা চেপে ধরল ফারিয়ার। এগোতে পারছে না সে।পেছন ফিরলো তখনই। দেখল, মুমূর্ষ ছেলেটার ঠোঁট কাঁপছে। “পানি পানি” অস্পষ্ট আওয়াজ জোর করে বেরিয়ে আসছে রক্ত ভেজা মুখ থেকে।ছেলেটার রক্ত-মাখা মুখটা ফারিয়ার লাল হৃদয়ের চিলেকোঠায় উঁকি দেয়া টুকটুকে সূর্যের মতন ঠেকলো। এরকম অনুভব কোথা থেকে কেন এল, এই ভাবনার এলোমেলো ঠিকানার সাথে ফারিয়া অপরিচিত, বে-মালুম।
ফারিয়া এক রকমের ঝাঁপিয়ে পড়ল মৃত্যুমুখী ছেলেটার পাশে। বোতলের সিপি সরিয়ে পানি এগিয়ে দিলো। কাঁপা-কাঁপা হাতে পানি ঢেলে দিল তার মুখে। পানি পেয়ে সে হঠাৎ নীরব হয়ে গেল। ঠোঁট আর কাঁপছে না এখন। আগের মত নড়ছে না রক্ত-জমা চোখের পাপড়ি দুটো। “এ যেন সাক্ষাৎ বিপদ ডেকে আনার নামান্তর। নতুবা, পানি পেয়ে সারা-শব্দ দূর হয়ে গেলে কেন। নাকি এই পরিস্থিতিতে পানি দেয়াটা ছিল বড় রকমের ভুল সিদ্ধান্ত। হয়তোবা ভুল”— বোতলের ছিপি লাগাতে লাগাতে ভাবছে ফারিয়া। এমন সময় তাকে অবাক করে দিয়ে অজ্ঞাত লোকটার শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত চালান হতে লাগলো। ভয়ে ফারিয়ার চোখ দুটো ছানাবরা। সিদ্ধান্তহীনতায় সে।কি রেখে কি করবে বুঝতে পারছে না। এরকম দুরবস্থার সম্মুখীন সে এই প্রথম। তার জায়গায় অন্য কেউ হলে নিশ্চয়ই ঘাবড়ে যেত। এড়িয়ে যেত অজ্ঞাত ব্যক্তির বিপদ। নিজ ব্যস্ততা থাকতো সবার আগে। কিন্তু এরকমটা করতে পারেনি ফারিয়া। সাহস রেখেছে। নিজেকে রেখেছে দায়িত্ব বাহকদের সামনের সারিতে। তার মতন কিছু মানুষের জন্যই হয়তো ‘উপকার’ শব্দটা আজও জীবিত। জাগ্রত ।
কিছুটা ভরকে গেলেও দূরে গেল না সে। মোবাইল বের করল। অ্যাম্বুলেন্স ডাকলো দ্রুত।
মিনিট কয়েকের ভেতর অ্যাম্বুলেন্স উপস্থিত। তখনই এসে ব্রেক নিলো পুলিশের একটি জিপ। ঝপাঝপ এগিয়ে এলো দুজন পুলিশ কর্মকর্তা। আহত ছেলেটাকে জিপে উঠানো হলো তড়িঘড়ি করে। পরিস্থিতির দাবি ছিল, অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নেওয়া। পুলিশ মহোদয়গণ সেটা করলেন না। কিন্তু কেন, এর জবাব কেবল তাদের-ই জানা। হয়তো উচ্চ চিকিৎসার জন্য ভিন্ন কোন ব্যবস্থা নেবেন!
পুলিশ দেখে ফারিয়া নিথর দাঁড়ানো। জুবুথুবু হয়ে কাঁপছে সে। যেন মেঘের শীত তাকে এই বর্ষাকালে নীরবে জড়িয়ে নিয়েছে। “এখানে দাঁড়িয়ে থাকা অনিরাপদ। ঝামেলার সমূহ সম্ভাবনা। আইনের মার-প্যাঁচ ঘোঁচানো বড্ড মুশকিল” নানান ভাবনা ভেবে কেটে পড়তে যাবে ফারিয়া, হঠাৎ পেছন থেকে কেউ ডাকলো। মেয়েলি এক গাম্ভীর্যপূর্ণ সুরে ভেসে এলো — “ইউ আর আন্ডার এরেস্ট “
Website: www.ichchashakti.com E-mail: ichchashaktipublication@gmail.com