সময়টা ছিলো ২০২৩ সাল। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে আয়াত। ছোট বেলা থেকেই মাদ্রাসায় পড়াশোনা, আয়াত পড়াশোনায় ছিলো ক্লাসের প্রথম ছাত্রী। আয়াতের গ্রামের নাম বিজয়পুর। আর বিজয়পুরেই ছিলো একটি গার্লস মাদ্রাসা সেখানেই দাখিল পর্যন্ত পড়াশোনা। এক এক করে কেটে গোলা বিজয়পুর মাদ্রাসায় ১০টি বছর। তারপর আলিম পড়ার জন্য বিজয়পুর এর পরে অন্য একটি গ্রামে ভর্তি হয় আয়াত। নিজ গ্রাম থেকে অনেকটাই দূরবর্তী ছিলো আলিম মাদ্রাসা। অবশ্য আয়াত তার বাবার সাথেই সাদ্রাসায় যাওয়া আসা করতো। আয়াতের বাবা ছিলো আলিম মাদ্রাসারই শিক্ষক, তাই আলিম এর সময়টা খুব সুন্দরভাবেই কাটছিলো আয়াতের। শ্রেনী-শিক্ষকরাও আয়াতকে ছাত্রী হিসেবে অনেক স্নেহ করতো। মাদ্রাসার প্রতিটি আঙ্গিনায় পরতে- পরতে দুই বছরে অনেক স্মৃতি কুড়িয়েছে আয়াত। খুব অল্প সময়েই যেনো অনেক আপন করে নিয়েছে মাদ্রাসার প্রতিটি ক্লাসমেটও সকল শিক্ষকদের।
এবার তবে ফিরা যাক ২০২৩ সালে।আয়াতের আলিম পরীক্ষা ২০২৩ সালের আগস্ট মাসের ২৭ তারিখ শুরু হয়। নিজ গ্রাম থেকে প্রায় ২ ঘন্টা লাগে পরীক্ষার সেন্টারে যেতে তাও আবার সি এন জি তে। তাহলে অনেক দূরের পথ। আয়াত এর আলিম মাদ্রাসা যেই গ্রামে ঐ গ্রামের থানার কাছাকাছিই সেন্টার। অন্যান্য সকল ক্লাসমেটদের জন্য তাও একটু কাছে কারণ মাদ্রাসার সাথেই বাড়ি তাদের, অনেকের আবার সেন্টারে যাওয়ার পথে। তাই আমাতের জন্য বাকিদের থেকে দূরেই ছিলো অনেকটা। সেন্টারে যাওয়ার জন্য সকলেই সি এন-জি ঠিক করলো। আয়াতের সাথে ছিলো তার খুব প্রিয় দুজন ফ্রেন্ড… রুমা এবং তামান্না। রুমা অবশ্য আয়াতের নিজ গ্রামের। তাই একসাথেই যাবে ঠিক করলো। -আর ছিলো তামান্না। এই তিনজন মেয়ে আর- একজন ছেলে যে কিনা সামনে বসতো ড্রাইভারের সাথে, আয়াতের সাথে প্রতিজনেরই খুব ভালো বন্ধুত্ব। ছেলেটাও পড়াশোনায় ভালো। নাম ছিলো সাঈদুর রহমান। যাই হোক, শুরু হয় আলিম পরীক্ষা। যাওয়ার পথে সি এন জি তে বসে সবাই মিলে সে কি আলাপ আলোচনা।পুরো রাস্তাই মাতিয়ে রাখতো কথা আর হাসাহাসিতে। আয়াত আর তমান্নাই বেশি কথা বলতো গাড়িতে আর রুমা ছিলো মুগ্ধ শ্রোতা। কথা বলার জন্য রুমা কখনো মাঝখানে বসতোইনা, আয়াত আর তামান্নাকে দিতো একসাথে না হলে দুইজন কথা বলতে পারবেনা। আর বাকি সাঈদুর রহমান সে তো সামনে বসে বসে হয়তো ভাবতো মেয়েরা যে কিভাবে পারে এতো কথা বলতে। বেচারার সাথে কথা বলার কেউ নাই। একিতো সামনে বসতো তাও ছেলে শুধু সে একাই। ড্রাইভার আংকেলের সাথে কি আর বন্ধুদের মতো কথা বলা যায়! মাঝে মাঝে সাঈদুর রহমান আর ড্রাইভার আয়াতদেরকে নিয়ে হাসাহাসি করতো বেশি কথা বলার জন্য।
কতো যে ওয়াজ নসিহত শুনেছে তারা কথা বলার জন্য সে বলে বুঝানো যাবেনা! আয়াতদের সাথে মাঝে মাঝে আয়াতের বাবা যেতো সেন্টারে। বাড়ি থেকে অনেকটা পথ এগিয়েও দিয়ে আসতো মেয়েকে যেদিন সাথে যেতোনা ঐদিন।মাঝে মাঝে আবার মাদ্রাসার শিক্ষাকরাও যেতো আয়াতদের গাড়িতে। মজাও করতো তারা- অনেক। ক্রমে ক্রমে ৬টি পরীক্ষা শেষ হলো। ঠিকঠাক চলছিলো সবকিছুই। পরীক্ষা আলহামদুলিল্লাহ ভালোই হচ্ছিলো। ৭ম পরীক্ষার দিন আয়াতদের সাথে আয়াতের বাবা যায়নি, এগিয়ে দিয়ে এসেছিলো। যাওয়ার পথে একজন শিক্ষক গিয়েছিল আসার পথে আর অভিভাবক কেউ ছিলোনা। প্রতিদিনকার মতোই সেন্টার থেকে বাড়ি ফিরার জন্য রওনা হয় সি এন জিতে। আজ পরীক্ষার শেষে আয়াতের আরেকটা ফ্রেন্ড ইকরা তাদের সাথে গাড়িতে ওঠে। কিছু পথ গিয়েই সে নেমে যাবে তাই সামনেই বসলো।৫/৬ মিনিট গিয়েই ইকরা নেমে যায় কারণ ও ও আজ অন্যত্র যাবে তাই তাদের গাড়িতে যায়নি। ওটা আগেই চলে গিয়েছে, যেহেতু ইকরা যাবেনা। ইকরা বসেছিলো ডান পাশে, ঠিক তার পেছনেই ডান পাশে ছিলো আয়াত, মাঝখানে তামান্না আর বাম পাশে রুমা। সামনের বাম পাশে সাঈদ।ইকরা সাথে থাকায় কয়েক মিনিটের পথ বেশ জমেছিলো কথার আসরে। কারণ ইকরা ছিলো অনেক দুষ্টু। বেশি কথা বলতো ও হাসাতো। তারপর ইকরার ও সময় ফুরিয়ে এলো মানে ইকরা নেমে যায় তার গন্তব্যে পৌঁছাতে।
বাকিরা রয়ে গেলো নিয়ম অনুযায়ী। কে জানতো আজ আয়াতের কথার ভান্ডার স্তব্দ হয়ে আসবে, নিরব ভয়ংকর হয়ে যাবে যাওয়ার পথ! ….. ইকরাও অনেক ভাগ্যবতী বলতে হয়। কারণ,যেই গাড়িতে ও কিছুক্ষনের অতিথি হয়েছিলো সেই গাড়িরই ঠিক ডান পাশে ধেয়ে আসে এক অপ্রস্তুত ভয়ানক বিপদ! এটা আল্লাহর বিশেষ রহমত বই কি! যা হোক.,,,গাড়িতে বসে সবাই কথা বলছে। আয়াতের হাতে আইসক্রিম ছিলো সেটা অনেক তৃপ্তিসহকারে সে খাচ্ছিলো। আইসক্রিম ছিলো আয়াতের প্রিয় খাবারের মধ্যে একটি। তামান্না, রুমা,সাঈদ যে যার মতো বসে আছে। সি এন-জি মেইন রোডে ঢুকলো সবে মাত্র। হঠাৎ করেই সামনের দিক থেকে আরেকটি সি. এন. জি আসছিলো !!!! ড্রাইভার আংকেল তার পাশ কাটাতে আচমকাই গাড়ি যে কখন অপ্রস্তুত ব্রেক নিলো, বুঝার জো নেই। পুরো সি এন জি প্রায়ই এক খাঁদে পড়ে যাচ্ছিলো তাই খাঁদ থেকে বাঁচাতে উল্টো দিকে ব্রেক নিলো, সাথে সাথেই দুই সি এন জি এক সাথে সংঘর্ষ লাগে। আয়াত বুঝতে পারেনি যে কিছু একটা হয়েছে ওর। শুধু আন্তাজ করলো এক্সিডেন্ট হতে যাচ্ছিলো। বাকিরা বুঝে নিজেদের সতর্ক করে শক্ত করে ধরে ফেললেও আয়াতের হাতে আইসক্রিম থাকায় ও কিছু বুঝে উঠতে পারলোনা। আয়াত খুবই হালকা, পাতলা, চিকন প্রকৃতির মেয়ে তাই গাড়ির ব্রেক এর সাথে মাথা ঝুকে বাহিরের দিকে চলে যায়!
অপর প্রান্তের লোকিং গ্লাসের সাথে মুখের ডান পাশ-ডান হাত লেগে আয়াত আবার ছিটকে পড়ে গাড়ির ভিতরে!
তখনও বুঝেনি কেউ আয়াত এর যে এক্সিডেন্ট হয়েছে, আয়াত ও বুঝেনি। হঠাৎ এক ভীতিকর শব্দ করে আয়াত তামান্নার উপর পরে! তানহা তাকিয়ে দেখে আয়াতের রক্তাক্ত মুখ!! ভয়ে সে শীতল হয়ে যায়, রুমা, সাঈদ এবং ড্রাইভারকে বললে সবাই নির্বাক !!!
কি?,,,
আয়াত!!!!!কিভাবে সম্ভব!
কারো কিছু হলোনা, সি.এন জি ও ঠিকঠাক। তাহলে?
কেও বুঝেইনি সি এন জি এর লোকিং গ্লাস আয়াতের ওপর দিয়ে ভেঙ্গে চুড়মার হয়ে গেছে।
আয়াত কাতরাচ্ছে আর বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে যেনো এই বুঝি রুহ চলে গেলো!
ছিটকে পড়লো তামান্না, রুমার ওপর বেহুশ হয়ে। বেহুশ হওয়াতে সবাই আরো ভয় পেয়ে যায়। ইতিমধ্যেই আয়াতের খিঁচুনি উঠে গেছে।
অনেক কষ্টে দু-তিনবার বললো তামান্না আব্বুকে কল দাও, তামান্না আব্বু কে কল দাও! এখন সবাই ভয়ে কাতর। ড্রাইভার ও অনেক হতবাক হয়ে গেলো। পথ ও যে ফুরাচ্ছেনা। অনেক পথ, প্রায় ১ ঘন্টা। এদিকে আয়াতের রক্তে শরীরের বোরকা, হিজাব লাল হয়ে যাচ্ছে। মুখে স্পর্ষ করা যাচ্ছেনা। আঘাতটা বেশ তীব্র, খানিকটা চামড়া সরে গিয়েছে চোখের নিচের গালের থেকে। হাতেও বেশ চুট লেগেছিলো, ধরাই যাচ্ছেনা যেনো। আয়াত আধমরা হয়ে পড়ে আছে তামান্না, রুমা র কুলের উপর তারা ধরে রাখতে পারছেনা, তাই সাঈদও পিছনে এসে বসে আয়াতের পাশে। সাঈদ এর সাদা পাঞ্জাবি রক্তে লাল হয়ে যায় সাথে তামান্নার স্কার্ট ও। অনেকক্ষণ এভাবে থাকার পর আয়াতকে একটা হাসপাতালে এডমিট করা হয়। তাদের মাদ্রাসা থেকে ১৫ কি ২০ লাগে ওখানে আসতে, তবে পরীক্ষার সেন্টার থেকে অনেক দূর।
আয়াতের আব্বুকে জানানো হলো, তখন খাবারের সময় ছিলো সাদ্রাসায় মানে লেইজার পিরিয়ড চলছে। আয়াতের আব্বু খাবার মুখে দিবে আর ফোন আসালো হাসপাতাল থেকে। সে খাবার আর মুখে উঠলোনা। ছুটে গেলো আয়াতের কাছে! আয়াতের অবস্থা দেখে আয়াতের আব্বু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেনা তাই বাকিরা বুঝিয়ে অন্য রুমে নিয়ে গেলো। চোখের একদম পাশ ঘেসে গালের উপরে, চোখের উপরে ঌটা সেলাই লাগলো!
ইস কি মর্মান্তিক অবস্থা!
প্রতিটা সেলাই আয়াত অনুভব করছে। ডান হাতের মধ্য আঙ্গুলে ২টা সেলাই। হাত প্রায় অবস, ব্যাথায় জর্জরিত পুরো হাত। আয়াত হুশে ফিরেই সেকি কান্না! কিভাবে পরীক্ষা দিবে, কিভাবে লিখবে। নিজেকে মানাতেই পারছেনা আয়াত। হাতে মোখে, চোখে ব্যান্ডেজ নিয়ে কিভাবে পরীক্ষা দিবে সে। সৃজনশীল পরীক্ষা গুলাই বাকি। অনেক লিখা, সে কি পারবে? আয়াত শুধুই কান্না করছে। সারাদিন না খেয়ে সব ফ্রেন্ডরা তার সাথে, মানে যারা মারা ছিলো। সন্ধ্যা হলো, আয়াতকে নিয়ে আসা হলো বাড়িতে। ২ দিন পর আবার পরীক্ষা। সে যে পড়তে পারবেনা, লিখতে পারবেনা। তবে কি আয়াত পারবে সব বাধা অতিক্রম করে পরীক্ষা দিতে?
আয়াত হাল ছাড়েনি! আল্লাহর অশেষ মেহের বাণিতে, পরিবারের একান্ত পরিচর্যায় আয়াতের মনের দৃঢ় মনোবলে সে পরীক্ষা দিবে ঠিক করলো। তাকে দিয়ে যে মাদ্রাসা ভালো একটা ফলাফল আশা করছে, মাঝপথে থেমে গেলে হবে না। দৃঢ় মানাবল ও সকলের অনুপ্রেরণায় আয়াতও অনেকটা সাহস পেলো। লিখতে পারতোনা আয়াত, যেই হাতে লিখবে সেই হাতের লিখার প্রধান আঙ্গুলেই সেলাই, নিচের দিকে তাকাতেও পারেনা আয়াত! দৃঢ় মনোবল নিয়ে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রেখে ২দিন পর পরীক্ষা দিতে যায় আয়াত। খুবই সম্ভবত আল্লাহর রহমতের এক জলন্ত দৃষ্টান্ত আয়াত। যে কিনা বাড়িতে ১/২ পৃষ্ঠা লিখা লিখতে চেষ্টা করায় অনেক কষ্ট হতো, সে আজ তিন ঘন্টার মধ্যেই ১০০ নাম্বারের সৃজনশীল পরীক্ষায় সমস্ত লিখা সম্পন্ন করলো, আলহামদুলিল্লাহ। এ যেনো মহান রবের পক্ষ থেকে এক অলৌকিক শক্তি। আয়াত ভাবতেও পারেনি সে নির্দিষ্ট সময়ে লিখা শেষ করতে পারবে, সে বুঝলো আল্লাহ আমার ওপর অশেষ মেহেরবানি করেছেন। এভাবেই বাকি পরীক্ষা গুলো মনের শক্তি, আল্লাহর রহমত ও পরম দয়ায় শেষ করলো আয়াত। আয়াতের জীবনে যেনো এই দুর্ঘটনা আল্লাহর সীমাহিন দয়ার এক জলন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে চিরকাল। এভাবেই পরীক্ষা দিয়ে পুরো প্রতিষ্ঠানকে একটি আশানুরুপ ভালো ফলাফল ও প্রতিষ্ঠানের সুনাম বজায় রাখে আয়াত। সে জি পি এ 5 পেয়ে উত্তীর্ণ হয়, আলহামদুলিল্লাহ। ঐ দিন আয়াত দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে আল্লাহর কাছে চরম খুশিতে শুকরিয়া জানায়।
পরম মমতায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা আয়াতকে হাদছানি দিয়ে আগলে রাখে তার জীবনের এই সময়টাতে।
আর এভাবেই স্মৃতি হয়ে থাকবে আয়াতের জীবনের রোড এক্সিডেন্ট।
চান্দিনা, কুমিল্লা
বাংলাদেশ