Addition শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো আসক্তি। এটি ল্যাটিন শব্দ Addico থেকে এসেছে। যার ইতিবাচক অর্থ ভক্তি, নিষ্ঠা এবং নেতিবাচক অর্থ দাসত্ব। আসক্তি বলতে আমরা শুধু মাদকের প্রতি আসক্তিকেই বুঝি। কিন্তু বর্তমানে মানুষ অনেক জিনিসের উপরই আসক্ত। যেমন : মাদক,স্মার্ট ফোন, কম্পিউটার গেম, নারী ইত্যাদি। আজকাল আসক্তি কথাটি আমাদের চারপাশে ব্যাপক শোনা যাচ্ছে। যুবক সমাজ আজ ক্রমেই আসক্ত নামক শব্দের সাথে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে আমাদের যুব সমাজ আজ ধ্বংসের পথে। আসক্তি আমাদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং পারিবারিক জীবনে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। এলসা পাটাকি নেশাকে ব্যায়ামের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, নেশা আর ব্যায়াম প্রায় একই রকম, যাতে একবার অভ্যস্ত হলে, তার শরীরে লাগবেই। অর্থাৎ কোনো কিছুতে আসক্ত হয়ে পড়লে তা থেকে সহজে বের হওয়া যায় না। ডা. গাবোর মেইট এর মতে, সব ধরনের আসক্তির পেছনে থাকে মানুষের ভেতরের প্রোথিত ভীতি বা যন্ত্রনা। অর্থাৎ মানুষ সহজেই কোন কিছুতে আসক্ত হয় না। এর পেছনে রয়েছে অনেক অভূতপূর্ব কারণ।
কয়েকটি আসক্তি সম্পর্কে জানলে আমরা আরও ভালো ভাবে আসক্তি সম্পর্কে জানতে পারবো। কয়েকটি আসক্তি সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো।
১. স্মার্টফোন আসক্তি :আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে সম্পৃক্ত একটি অন্যতম মাধ্যম হলো মোবাইল ফোন বা স্মার্ট ফোন। যা দৈনন্দিন জীবনে মানুষের অনেক সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার যেমন মানুষের মাঝে প্রভাব ফেলতে পারে, তেমনি মানুষের মন মেজাজ স্মার্ট ফোন ব্যবহারের পরিমাণকে প্রভাবিত করতে পারে।
স্মার্টফোনের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি, সেই সঙ্গে শারীরিক কর্মকান্ডের সুযোগ না পাওয়া, এই দুই সমস্যা মিলে সৃষ্টি হচ্ছে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া। এই সমস্যাটি যদি দীর্ঘমেয়াদি হয় তাহলে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আশঙ্কার একটি কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মোবাইল ফোন গেম এখন আসক্তির পর্যায়ে চলে গেছে। ইলেকট্রনিক ডিভাইসে অতিরিক্ত গেম আসক্তিতে শিশুদের দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাধা পাচ্ছে মানসিক বিকাশ।
অনলাইন গেমিং আসক্তিকে মানসিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
মোবাইল গেমের কারনে শিশুরা লেখাপড়ায় বিমুখী হয়ে পড়ছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, করোনায় গত দেড় বছরে দেশে শিক্ষার্থীর মোবাইল আসক্তি বেড়েছে প্রায় ৬৭ শতাংশ।
২. মাদকাসক্তি :বর্তমানে মাদকাসক্তি একটি ভয়াবহ বৈশ্বিক সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। আসক্তিতে আমাদের দেশের বিশেষ করে তরুন ও যুবসমাজ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাদক সেবণের উচ্চ আকাঙ্ক্ষাকে বলে মাদকাসক্তি। মাদকাসক্তি এমন এক নেশা যাতে একবার জড়িয়ে পড়লে তা থেকে সহজে মুক্তি পাওয়া যায় না। এর পরিণতি ভয়াবহ। বিভিন্ন মাদক যেমন সিগারেট, মদ, গাঁজা, মরফিন, কোকেন,প্যাথেড্রিন, চরস, কপি, মারিজুয়ানা ইত্যাদি উল্লেখযোগ। বর্তমানে তরুণ ও যুব সমাজের বড় একটি অংশ এসব মাদক গ্রহণের মধ্য দিয়ে নিজেদের ধ্বংস করার খেলায় মেতে উঠে।এসব মাদক সেবনের মধ্য দিয়ে নিজেদের যেমন শারীরিক মানসিক সমস্যা হচ্ছে তেমনি এরফলে পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্র অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
৩.নারীর প্রতি আসক্তি : আজকাল দেখা যায় স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ ছুটির সময় কিছু যুবক রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে কিংবা নিকটবর্তী দোকানের সামনে বসে থাকে মেয়েদের দেখার জন্য। বর্তমানে এরুপ ঘটনা প্রায় দেখা যায়। নারীর প্রতি আসক্তি বর্তমানে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। রাসুল সা: বলেছেন, আমি চলে যাওয়ার পরে আমার উম্মতের জন্য সব রকম ক্ষতিকর যে ফিতনা রেখে যাচ্ছি সেটা হচ্ছে, একজন পুরুষের জন্য একজন নারীর প্রতি আসক্তি। ( বুখারী ৫০৯৬,মুসলিম ২৭৪০)
নারীর প্রতি আসক্তি বা আকর্ষণের ফলে অনেক বড় খ্যাতিমান মানুষকে পথভ্রষ্ট করে দিয়েছে। কত সুফি সাহেবকে ভুল পথে নামিয়ে দিয়েছে। কত সুন্দর পরিবেশকে ধ্বংস করে দেয়। মানুষকে শয়তানের গোলাম বানিয়ে দেয়।
পর নারীর প্রতি আকর্ষণের ফলে যুবকরা পর্নোগ্রাফি দেখে। যা তাদের মস্তিষ্ককে নানাভাবে প্রভাবিত করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে ১১ থেকে ২৩ বছর বয়সের যুবকরা বেশি পর্নোগ্রাফি দেখে।
৪.যৌন আসক্তি :যৌন আসক্তির ফলে আমাদের দেশের যুবকেরা পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হচ্ছে।ফলে দেশে বর্তমানে ধর্ষণের মতো ঘৃণিত কাজ বেড়ে যাচ্ছে।আসক্ত ব্যক্তি এরকম ঘৃণিত কাজ করতে দ্বিধা করে না।আজকাল পত্র-পত্রিকায় এরকম খবর প্রায়ই দেখা যাচ্ছে। যৌন আসক্তি অন্যান্য আসক্তির মতে বিপদজনক।যৌন আসক্তি এমন একটি অবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তি তার চিন্তা-ভাবনা ও যৌন আচরণের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। তার মন সর্বদা যৌন উত্তেজনা বা অতি যৌনতার চিন্তায় পূর্ণ থাকে। ফলে তার বারবার যৌন কার্যকলাপ করার ইচ্ছা জাগে। এটি তার মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি তার সামাজিক ও মানসিক অভ্যাসের উপর প্রভাব ফেলে। যখন একজন ব্যক্তি যৌন কার্যকলাপে আসক্ত হন, তখন তার সম্পূর্ণ মনোযোগ যৌনতা এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলির উপর থাকে। আসক্ত ব্যক্তি সহজে তার যৌন ইচ্ছা এবং কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হন না।
যৌন আসক্তি সম্পর্কে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. বীনা কৃষাণ বলেন,যৌন আসক্তির কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি পর্নোগ্রাফি ও হস্তমৈথুনের প্রতি ও আসক্ত হয়ে পড়েন। অনেক সময় যৌন ইচ্ছা সম্পূর্ণ করার জন্য, একজন ব্যক্তি একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন শুরু করেন।
পরিশেষে,আসক্তির ফলে অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয়। তরুণ শিক্ষার্থীরা মোবাইল, কম্পিউটার গেম ইত্যাদিতে সময় কাটায়। ফলে পড়ালেখার প্রতি বিমুখ হয়ে পড়ছে। অপরদিকে যুব সমাজ মাদক, স্মার্টফোনে আসক্ত হয় তাদের জীবনকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করছে। এতে রাষ্ট্রের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। কারণ শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার প্রতি অনিহার ফলে বিভিন্ন আসক্তিতে আসক্ত থাকার ফলে দেশের শিক্ষার হার কমে যাচ্ছে। যা ভবিষ্যতে দেশের জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে আনবে। অপরদিকে যৌন আসক্ত ব্যক্তি নিজেদের যেমন ক্ষতি করছে, তেমনি দেশ ও জাতির ক্ষতি করছে। দেশে ধর্ষণের মতো ঘৃণিত কাজ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে দেশে নারী সমাজের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এ সকল আসক্তি থেকে মুক্ত হওয়া খুবই জরুরী। এসকল আসক্তি কমাতে যা করণীয়ঃ-
১. স্মার্ট ফোনের আশক্তি কমাতে সাধারণ মোবাইল ফোন ব্যবহার করা।
২. প্রতিদিন সকালে পত্রিকা ও রাতে বই পড়ার অভ্যাস করা।
৩. কোন মিটিং এবং ক্লাসে ফোন বন্ধ করে ব্যাগ কিংবা ড্রয়ারে রেখে দেওয়া।
৪. মোবাইল ফোনে ইমেইলের উত্তর দেয়ার পরিবর্তে ল্যাপটপ কিংবা কম্পিউটারে অভ্যাস করা।
৫. ঘুমানোর সময় বালিশের পাশে স্মার্টফোনের পর্দায় চোখ না রাখা।
৬. বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিংবা খেলার মাঠে নিজের অংশগ্রহণ বাড়ানোর চেষ্টা করা।
৭. মাদকের কুফল সম্পর্কে নিজে জানতে হবে এবং অন্যদের জানাতে হবে।
৮.প্রয়োজন ছাড়া বেশি সময় নিয়ে কম্পিউটার ব্যবহার না করা ।
৯.অযথা রাস্তায় বা দোকানে বসে বাজে আড্ডা না দেওয়া।
১০.অসৎ সঙ্গ পরিত্যাগ করা।
লেখক :-
নাম : ইকরামুল ইসলাম লিহান
জেলা : লক্ষ্মীপুর
Website: www.ichchashakti.com E-mail: ichchashaktipublication@gmail.com