মনে পড়ে গ্রন্থাগারের স্মৃতি
এস এ বিপ্লব , নারায়ণগঞ্জ
ইচ্ছাশক্তি সাহিত্য আইডি নং ০০২২০২০৮৬৯
আমি এস এ বিপ্লব, নারায়ণগঞ্জের ছেলে।পাঠাগারে কিভাবে আমার যাওয়া শুরু হয়। মূলত বলতে গেলে আমার ভাইয়ের মাধ্যমে শুরু হয়। ছোট বেলায় আমার সেজো ভাই( জিয়া) প্রায়ই কোথায় যেন চলে যেত। এভাবে প্রতিদিন বিকালে বের হয়ে যায় আর সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে। তাই একদিন তার পিছু নিলাম দেখি সে কোথায় যায়? তখন গিয়ে দেখি গ্রন্হাগারে, এবং এই আলী আহাম্মেদ চুনকা পাঠাগারে।সেদিন ঘুরে ঘুরে পুরো পাঠাগার দেখি, আর মনে ভিতর স্হান করে নেয়।সেই থেকে আমার পাঠাগারে যাও্যা আসা শুরু। এরপর ধীরে ধীরে পাঠাগার থেকে অনেকের সাথে পরিচিতি হয়।
আমার একজন গুরু ছিল,নাম তৌফিক হোসেন। তিনি প্রায় বছর কয়েক হবে মারা গেছে। গুরু সবাইকে বানানো যায় না। তাকে গুরু বানানোর কারন তিনি ছিলেন আমার মতন পাঠাগার ভক্ত একজন লোক। তার কাছে বিশ্বের সব খবর পাওয়া যেত। এমন কি তার সাথে আমার পরিচয় হয়ে থাকে গ্রন্হাগার থেকেই।তিনি এমন একজন লোক যে কিনা সকাল – বিকাল দুবেলা গ্রন্হাগারে না গেলে তার উদরের অন্ন হজম হতো না। এক সময় আমাদের একটা গ্রুপ তৈরী হয়, যাকে আমরা পাঠাগার গ্রুপ বলে ডাকতাম। কারন এখানে সবাই ছিলাম পাঠাগার থেকে পরিচয় তাই নাম হয় “পাঠাগার গ্রুপ”। এই গ্রুপে আমরা প্রায় দশ – বারো জন ছিলাম। মজার বিষয় হলো, আমাদের পাঠাগার গ্রুপের সবাই যখন এক সাথে গ্রন্হাগারে যেতাম তখন আমাদের বসার টেবিলে আর কোন লোক বসার স্হান পেত না। আমাদের গ্রুপের সবাই ছিল উচ্চ শিক্ষিত। কেউ শিক্ষক, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তার, ব্যাংকার, উকিল সহ আরো নানা পদের সাথে জড়িত।
আমি এই শহরেই বড় হয়েছি।তাই এই শহরের যত যা কিছু দেখেছি তার মধ্যে অন্যতম আমার আশ্রয় ছিল গ্রন্হাগার। এমন কি আমার জীবনে যত মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে তার বেশীর ভাগ গ্রন্হাগার থেকেই। তাই গ্রন্হগার কে শুধু আশ্রয় বলব না বরং আমার একান্ত ভাই – বন্ধু বা খেলার সাথী বলতে পারি।
কারন ছোটবেলা জনক- জননী কে হারিয়ে একা হয়ে থাকি। তারপর থেকে গ্রন্হাগারে অনেক সময় নাটক,কারাতে সহ নানান অনুষ্ঠান হতো সেগুলো দেখতে যেতাম। একটু আনন্দের জন্য। এই যাওয়া থেকেই ধীরে ধীরে আমার কাছের বন্ধু হিসেবে পরিনত হয়ে যায় গ্রন্হাগার। একপর্যায়ে আমি গ্রন্হাগার থেকে ছয়বার পুরষ্কার অর্জন করে থাকি।বইপাঠ, রচনা সহ নানান প্রতিযোগীতায় অংশ নিয়ে। সেই পুরষ্কারের আনন্দ যে কত বড় পাওয়া তা একমাত্র যে পেয়েছে সেই জানে। কেননা একটা পুরষ্কারের জন্য অনেক কিছু জানতে হয়,আর জানার জন্য বই পড়তে হয়।আর বই পড়তে হলে, সবচেয়ে যে মাধ্যম বেশী প্রয়োজন সেটা হলো গ্রণ্হাগার। আবার পুরষ্কার যারা দেয়, দিচ্ছে তারা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আয়োজন করে থাকে। তাতে করে সবাই জানে,এবং ডিসি সহ বড় বড় পদে থাকা মানুষ দের কাছ থেকে পুরষ্কার নেওয়া সেটাও সৌভাগ্যের বিষয়। পাঠাগারের পরিচালক গণ আমাকে উৎসাহ দিত অংশ গ্রহণ করার জন্য। বইপাঠ,রচনা সহ আরো নানা প্রতিযোগীতায়।
এমন কি গ্রন্হাগার কে ভালোবেসে পরবর্তীতে কয়েকটি গ্রন্হাগারের সদস্য হয়ে থাকি। যার মধ্যে ছিল, সরকারী জেলা গণ গ্রন্হাগার, সুধীজন পাঠাগার,নুরুলহক গ্রন্হাগার আর একটি ছিল আলী আহাম্মদ চুনকা পৌর পাঠাগার। এই আলী আহাম্মদ চুনকা পৌর পাঠাগার থেকেই আমার পাঠাগারে যাত্রা শুরু।পাঠাগারে বই পড়ার আর যাওয়া – আসাতে আজ আমি কলাম, কবিতা,গল্প দু- এক কলম লিখতে পারি।সত্যি বলতে কি, আমি মনে করি,” যে বই ভালোবাসে তার সাথে বই কথা বলে”। এই উপলব্ধি টা যে নিতে পারবে সে গ্রন্হাগার মুখী হবে। গ্রন্হাগারে যারা নিয়মিত যাওয়া – আসা করবে তারা সত্যি কারের মানুষে পরিনত হবে। তাদের দ্বারা কোনদিন কোন অন্যায়,অপরাধ হবে না। গ্রন্হাগার একজন মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে। এখনও সবাই কে বলি যে, পাঠাগারে কোন প্রতিযোগীতা হলে আমাকে জানাবেন। অংশ গ্রহণ করব, এটা থেকে দুরে সরে যেতে চাই না।
সর্বশেষ অনেক দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে, বলতে পারি গ্রন্হাগারের কারনে আজ আমাকে সবাই কবি বা লেখক হিসেবে জানে। গ্রন্হাগার আর লেখালেখি করা হলো আমার মনের খোরাক। তাই শত কষ্ট হলেও চেষ্টা করি সপ্তাহে দু- একদিন গ্রন্হাগারে যেতে। শুধু কি তাই গ্রতি গ্রন্হাগারে আমার কোন একক বই বের হওয়া মাত্র সৌজন্য কপি দিয়ে থাকি। এখন পর্যন্ত চারটি বই দেওয়া হয়েছে। সেই বইয়ের টানেও যেতে হয় আমাকে। যদিও পূর্বের মত করে সময় দিতে পারি না।
কিন্তু এখন কেন যেতে পারিনা সেটা কেউ জানতে চায় না। কিংবা জানার পরও যে ব্যবস্হা করে দিবে বা দিতে পারবে তা হয়তো পারবে না। এখন না যাওয়ার যত গুলো কারন আছে তার মধ্যে একটি প্রধান কারন হলো সংসার আর কর্ম জীবন। এর পরের কারন গুলো, আমাদের সেই পাঠাগার গ্রুপের দু- তিন জন ছাড়া আর কেউ নেই, সবাই চলে গেছে না ফেরার দেশে। তাই এখন সেখানে গেলে অনেকক্ষণ বসে নিরবে মনে পড়ে হারিয়ে যাওয়া মানুষ গুলোর কথা। মনে পড়ে সেই সব স্মৃতি। তাই নানা কারনে এখন কম যাওয়া হয়। আবার পাঠাগারে পরিচালক সহ পুরাতন অনেকে অবসরে গেছে। তারপরও হাজার কষ্ট হলেও আমি অন্তত গ্রন্হাগারে দু- এক ঘন্টার জন্য হলেও সময় দেওয়ার চেষ্টা করি।কারন এটা একটা ভালোবাসার টান। একজন লেখকের কাছে একটা বই মানে একটা সন্তান। ঠিক তেমনি একজন পাঠকের কাছে গ্রন্হাগার জনকের মতন। যেখানে গেলে মাথার উপরে ছায়া আর উৎসাহ, উদ্দিপনা, সাহস পাওয়া যায়। আমার যদি সাধ্য থাকত তবে নিজ এলাকাতে একটি গ্রন্হাগার স্হাপন করতাম। বাকি জীবন গ্রন্হাগারে কাটিয়ে দিতাম।