মফস্বল একটি শহরে বেড়ে উঠা মোনা এবং শ্রাবণের। ছোটবেলা থেকেই তারা এক সাথে বড় হয়েছে। এক সাথেই লেখাপড়া করেছে। সেদিক থেকে ছোটবেলা থেকেই তারা একে অপরের খুব ভালো বন্ধু। কোনোদিন তাদের মতের কোনো অমিল হয়নি। কখনো ঝগড়াও হয়নি। বরং বন্ধু মহলে তাদের বন্ধুত্বের অনেক সুনাম রয়েছে। মোনা অনেক নম্র-ভদ্র এবং স্বভাবজাত একটি মেয়ে। তার ব্যবহারের কোনো ত্রুটি নেই। খেলাধূলা এবং লেখাপড়ায় সবকিছুতেই অনেক পারদর্শী মোনা। যেমন দেখতে অনেক বেশি সুন্দর, তেমনি বিনয়ী তার ব্যবহার। বিশেষ করে সুন্দরের কোনো কমতি নেই তার। সব কাজ করতেই সে বেশ পারদর্শী। এই যেমন সাইকেল চালানি, নৌকা চালানি, জাল অথবা বঁড়শি দিয়ে মাছ ধরা, বড় কোনো মেশিন হাত দিয়ে স্টার্ট করা। গৃহস্থালি কাজ করতেও অনেক পারঙ্গম মোনা। সেদিক থেকে কারো কোনো অভিযোগ নেই মোনার প্রতি। বাবা-মায়ের অনেক আদরের মেয়ে সে। বাবা-মায়ের প্রতিটি কথা সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। মনোযোগ সহকারে সবকাজ করে ফেলে। কোনোকিছুর প্রতিই অমনোযোগী নয় মোনা। বলতে গেলে বাবা-মায়ের অনেক লক্ষ্মী একটা মেয়ে সে। ছোটবেলা থেকেই অনেক মেধাবী এবং পরিশ্রমী মোনা। নিজ প্রচেষ্টায় অনেক পুরস্কার পেয়েছে খেলাধূলা এবং লেখাপড়ায় ভালো ফলাফল অর্জন করার মাধ্যমে। তার বিনয়ী ব্যবহারে যে কেউ অনেক মুগ্ধ।
সুন্দর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে কথা বলতে পারাটাও তার জুরি নেই। বাচন ভঙ্গি অত্যন্ত চমৎকার। মুখে সদা হাসি রেখে সবার সাথে বিনয়ের সাথে কথা বলে। বলতে গেলে অতি সাধারণ মেয়েটা। কোনোকিছু না পেলেও কোনো আফসোস করে না। অর্থ আর বিত্তের প্রতিও কোনো মোহ নেই। বাবা প্রভাবশালী হলেও একদম কোনো অহংকার নেই। বরং কেউ কোনো বিপদে পড়লে সাথে সাথে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে সদা তৎপর। টাকা-পয়সা দিয়ে গরিব দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে সবসময় কোনো প্রকার স্বার্থহীন ভাবে। ধনী পরিবারের মেয়ে হয়েও নেই কোনো আত্মগরিমা। অনেক বেশি সুন্দরী হয়েও নেই কোনো রূপের অহংকার। খুব সাদামাটা তার জীবন চলা। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেও নেই কোনো গড়িমসি। কোনোদিন সে বিলাসিতায় নিজেকে জড়িয়ে আপাদমস্তক গিলে খায়নি। বরং স্বভাবজাত ব্যবহারে প্রতিনিয়ত সে সমাজে অবহেলিত এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছে মানব সেবামূলক কাজের মধ্য দিয়ে। পড়াশোনার পাশাপাশি পার্ট টাইম একটা জব করে মাস শেষে যে টাকা পায় তা নিজের খরচ থেকে বাঁচিয়ে বিলিয়ে দেয় গরিব দুঃখী মানুষের কল্যাণে। মোনার জীবনে ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ নেই। বরং অসহায় মানুষকে সাহায্য করতে পারলেই তার সব স্বার্থ সিদ্ধি হয়। তবে তার জীবনে সবচেয়ে প্রিয় এবং কাছের বন্ধু শ্রাবণের কথা না বললেই নয়। বন্ধুত্বের জায়গা থেকে শ্রাবণকে মোনা অনেক বেশি সম্মান করে। শ্রাবণও মোনাকে অনেক সম্মান করে। তবে নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় মোনাকে শ্রাবণ ভালোবেসে ফেলে। মোনাকে ভেবে কবিতা লিখতে থাকে। কিন্তু সাহস নিয়ে কখনো বলতে পারেনি শ্রাবণ মোনাকে ভালোবাসার কথা। তবুও একতরফা ভাবে মোনাকে শ্রাবণ ভালোবাসতে থাকে।
মোনাকে নিয়ে লেখা শ্রাবণের অনেক কবিতা জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে নিয়মিত প্রচার এবং প্রকাশ হতে থাকে। সেটাও মোনার অজানা থেকে যায়। এমনি করেই তাদের দিন চলতে থাকে। অনেক কিছুর প্রতি শ্রাবণের অনীহা থাকলেও সাহিত্য এবং সংস্কৃতি চর্চার প্রতি বেশ তৎপর। এই সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমেই শ্রাবণ বেঁচে থাকতে চায় গণমানুষের মনে। সেজন্য অনেক পরিশ্রমের মাধ্যমে শ্রাবণ নিজের প্রতিভাকে বিকশিত করতে সারাক্ষণ মোনার সাহায্য প্রত্যাশী। শ্রাবণের জীবনের কোনো গল্প মোনার অজানা নয়। এমনিতে শ্রাবণের কোনো বদ নেশা নেই। ছেলে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে মাঝে সাজে একটু ধূম পান করে। তবে এটা কোনো অভ্যাস নয়। বন্ধুদের জোরাজোরিতে নিয়ম পালন করতে হয় আর কি ! এটাও শ্রাবণকে মোনা নিষেধ করে দিয়েছে। মোনা চায় না তার প্রিয় বন্ধু কোনো বদ নেশায় আসক্ত হয়ে যাক। মোনা এটাও চায় না শ্রাবণের আর কোনো বন্ধু-বান্ধবী থাক। মোনা চায় শ্রাবণের একমাত্র বন্ধু থাকবে সে। অবশ্য শ্রাবণেরও সেটা অজানা নয়। তাই বেশির ভাগ সময়টা শ্রাবণ মোনার সাথেই অতিবাহিত করে। মোনার পরিবারের সবাই জানে শ্রাবণ তার খুব ভালো একটা বন্ধু। তাই শ্রাবণের সাথে সময় কাটাতে মোনার পরিবারের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। যখন তখন মোনার বাসার দরজা শ্রাবণের জন্য খোলা থাকে। বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন হলেই শ্রাবণকে মোনা দাওয়াত করে। সমস্যা না হলে শ্রাবণও মোনার দাওয়াতে সাড়া দিতে কখনো মিস করে না। কারণ শ্রাবণ জানে বিনা কারণে দাওয়াত মিস করলেই অবসম্ভাবি তাকে মোনার হাতের মার এবং শাস্তি পেতে হবে। কতোদিন যে শ্রাবণ মোনার হাতের মার খেয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
মোনার হাতের মার খাওয়াতেও শ্রাবণের কোনো অভিযোগ নেই। শ্রাবণের বিশ্বাস প্রিয় বন্ধুর হাতের মার খেলেও মানের কোনো ক্ষতি হয় না। দোষ করলে বন্ধু মারবে এটাই তার কাছে স্বাভাবিক। শ্রাবণ যে ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য চর্চা করে এটা মোনার কাছে অজানা নয়। বরং শ্রাবণকে বেশি বেশি লেখার জন্য মোনা সারাক্ষণ অনুপ্রাণিত করে। শ্রাবণ তাতে লিখতে আরো বেশি আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু মোনা জানেনা শ্রাবণ ইতোমধ্যে তাকে নিয়ে শতাধিক প্রেমের কবিতা লিখে ফেলেছে। সে কবিতাগুলো অবশ্য মোনা পত্রিকা এবং বইয়ের মাধ্যমে পড়েছে। কিন্তু মোনা জানে না কবিতাগুলো তাকে নিয়েই লেখা। অবশ্য শ্রাবণের কবিতা পড়ে মোনা প্রতিনিয়ত অনেক আনন্দ পায়। শ্রাবণকে সে কবিতাগুলো আবৃত্তি করে শোনায়। শ্রাবণ তখন মনে মনে অনেক খুশি হয়। খুশির কারণ তার প্রিয় মানুষ অনেক আগ্রহ নিয়ে তার কবিতা আবৃত্তি করে। এভাবেই চলতে থাকে তাদের রহস্যের সম্পর্ক। শেষ পর্যন্ত এই গল্পের সমাপ্তি কোথায় দাঁড়ায় সেটা আমরা কেউ জানিনা। সময় বলে দিবে কোন সম্পর্কটা আসলে টিকে থাকে। সময় এবং পরিস্থিতি আমাদের অনেক কিছুই বদলে দেয়। তখন আমাদের করার কিছু থাকে না। মেনে না নিয়ে আর কিছু করারও থাকে না। এই গল্পে শ্রাবণ এবং মোনার সম্পর্কও তাই। তাদের দু’জনের চাওয়া-পাওয়া শেষ পর্যন্ত কোথায় সীমাবদ্ধ থাকে তাদের এই গল্পের শেষ পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। প্রিয় পাঠক অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদেরও কিছু করার নেই যে !
(চলবে…)