আজ শুক্রবার। পাত্রপক্ষ থেকে মোনাকে দেখতে আসার কথা। তাই সকাল থেকেই মোনাদের বাসা সুন্দর করে সাজানো হচ্ছে। মোনাও কাজে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। নানান পদের খাবারের আয়োজন করা হচ্ছে। পাত্রপক্ষ থেকে মোনাকে দেখতে আসবে বিধায় বাসার সবার মাঝে এক প্রকার আনন্দ বিরাজ করছে। সবার মুখেই আনন্দের হাসি ফুটে উঠেছে। এতোকিছুর মাঝেও মোনার মনটা খুব খারাপ। কেননা পাত্রপক্ষ মোনাকে পছন্দ করলেই তার মনের বিরুদ্ধে তাকে কবুল বলতে হবে৷ মোনা চেয়েছিলো নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়েই বিয়ে করবে। কিন্তু হিতে বিপরীত হলো। বাবা-মায়ের অনুরোধ রক্ষা করতে গিয়ে নিজের ব্যক্তি স্বাধীনতা পশ্চাতে ফেলে দিতে হলো। এক প্রকার চাপা অভিমুখে নিজের মাঝেই নিজে কুঁকড়ে গেলো মোনা। এদিকে সকাল পেরিয়ে দুপুর হতে চললো। অথচ শ্রাবণের কোনো খবর নেই। সেজন্য মোনা কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েছে। এমন একটা দিনে শ্রাবণকে কাছে না পেলে নিজেকে খুব অপরাধী মনে করবে মোনা। তার একমাত্র কাছের মানুষ শ্রাবণ। অথচ এখনো মোনাদের বাসায় শ্রাবণের উপস্থিতি নেই। এমতাবস্থায় মোনা শ্রাবণকে ফোন করে বসলো। কয়েকবার পরে ফোনে শ্রাবণকে পাওয়া গেলো।
শ্রাবণ : হ্যা বলো...
মোনা : কোথায় তুমি ?
শ্রাবণ : আমি হসপিটালে...
মোনা : হসপিটালে কেন ?
শ্রাবণ : মা খুব অসুস্থ তাই মাকে নিয়ে আসছি...
মোনা : কি হয়েছে আন্টির ?
শ্রাবণ : এই প্রেসারের সমস্যা...
মোনা : তুমি কি তাহলে আসবে না আমাদের বাসায় ?
শ্রাবণ : আমি একাই মাকে নিয়ে আসছি। তাই কখন বাসায় ফিরতে পারবো জানিনা। ডাক্তার বলেছে দু'দিন এখানে থাকতে হবে। তারপর ছুটি দিবে।
মোনা : তাহলে আর কি ! এমন একটা দিনে তোমাকে কাছে পেলাম না। আমার কপালটাই খারাপ৷ ভালো কিছু আমার কপালে ফেভার করে না জানো ! আচ্ছা তাহলে থাকো। বেশি করে আন্টির সেবা যত্ন করো৷ কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানিও। এখন তাহলে ফোন রাখছি...
শ্রাবণ : ওকে ঠিক আছে। তোমার জন্য শুভ কামনা রইলো। ভালো থেকো তুমি।
এরপর দু'জনেই অফলাইনে চলে গেলো। এবার মোনাকে দেখার জন্য পাত্রপক্ষ কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। মোনাকে আপাদমস্তক খুব সুন্দর করে সাজানো হচ্ছে। দু'হাতে মেহেদী রাঙানো। কপালে লাল টিপ। ঠোঁটে গোলাপি রঙের হালকা লিপস্টিকের পোঁচ। চোখের পাপড়িসহ সমস্ত মুখে মেক-আপের আস্তরণ। নাকে স্বর্ণের রিং পরিহিত মোনাকে আজ ডানা কাটা পরীর মতোই সুন্দর লাগছে। এমনিতেই মোনা ভীষণ সুন্দরী। তার উপর আজকে বিয়ের সাজন সেজেছে। সবকিছু মিলে মোনাকে আজ অসম্ভব সুন্দর লাগছে।
মোনাকে সাজাতে সাজাতেই পাত্রপক্ষ চলে এলো। সবাই তাড়াহুড়ো করে পাত্রপক্ষকে বসতে দিলো। কেউ কেউ অজু করে প্রস্তুত হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের খাবার পরিবেশন করা হলো। পাত্রপক্ষ থেকে মোট পাঁচজন এসেছে। পাত্র, পাত্রের এক ভাবি, পাত্রের বড় বোন, পাত্রের বোন জামাই এবং পাত্রের বড় ভাই। মোট এই পাঁচজন এসেছে। কিছু সময় পর সবাই খাবার শেষ করলো। এবার মিনিট কয়েক বিশ্রাম নিয়ে মোনাকে দেখার পালা। পাত্রের নাম মাঈনুল। লাল পাঞ্জাবি পরিহিত মাঈনুলকে রাজপুত্রের মতোই অনেক সুন্দর লাগছে। দেখতে অনেকটাই নম্র ভদ্র। একদম সাদাসিধে। এমন একটা পাত্রকে মোনা নিজেও পছন্দ না করে থাকতে পারবে না। বলতে গেলে মোনা একদম নিজের স্বপ্নের মানুষকে স্বামী হিসেবে কাছে পেতে যাচ্ছে। এবার মোনাকে পাত্রপক্ষের কাছে নিয়ে আসা হলো। টেবিলের পর্ব পাশে পশ্চিম মুখ করে প্রথমেই মোনা পাত্রপক্ষকে সালাম দিলো। সবাই তার সালামের জবাব দিলো। কেউ একজনের অনুরোধে মোনা চেয়ারে বসলো মুখে ঘোমটা টেনে। মোনা তখন লজ্জা এবং ভয়ে ঘোমটার আড়ালে ঘেমে যাচ্ছে। এই প্রথম পাত্রপক্ষ থেকে মোনাকে দেখতে আসছে। এটাই তার প্রথম অভিজ্ঞতা। তাই কিছুটা বিচলিত হওয়াটাই স্বাভাবিক।
প্রথমেই পাত্রের ভাবি মোনাকে সুরা ফাতিহা পাঠ করার জন্য অনুরোধ করলো। মোনা অনেক সুন্দর করে সুরা ফাতিহা পাঠ করে সবাইকে শোনালো। সবাই তার সুরা ফাতিহা তেলাওয়াত শুনে প্রশংসা করলো। তারপর কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় মোনাকে। সবগুলো প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে মোনা সক্ষম হয়। সুরা ফাতিহা তেলাওয়াত এবং প্রশ্নের উত্তর মোনা ঘোমটার আড়াল থেকেই দিয়েছে। তারপর পাত্রের ভাবি চেয়ার থেকে উঠে মোনার মুখ থেকে ঘোমটা সরিয়ে দিলো। তখন বেরিয়ে এলো নিখুঁত কারুকার্যে গড়া মোনার সুন্দর মুখখানি। মানুষ তো নয় ; যেন একটা পরী বসে আছে পাত্রপক্ষের সামনে। সবাই মোনার সৌন্দর্য দেখে হতচকিত হলো। মোনাদের বাসার লোকজন এবং আশেপাশের লোকজন এসে মোনাকে ঘিরে রেখেছে। নেই শুধু মোনার সবচেয়ে কাছের মানুষ শ্রাবণ। মনে মনে শ্রাবণকে খুব মিস করছে মোনা। হয়তো বুকটা ফেটে যাচ্ছে মোনার শ্রাবণের জন্য। কিন্তু কিছু করার নেই। মা-বাবার পছন্দ মতোই মোনা বিয়ে করবে। তাইতো আজকের এই আয়োজন।
সবকিছু শেষে পাত্রপক্ষের সবাই মোনাকে খুব পছন্দ করলো। সেজন্য মোনাকে সম্মানী হিসেবে নতুন চকচকে পাঁচ হাজার টাকা দিলো। সেই সাথে একটা স্বর্ণের রিং পরিয়ে দিলো মোনার হাতের আঙুলে। এতোকিছুর মাঝেও মোনার মুখে কোনো হাসি নেই। পাত্র মাঈনুলকে পেতে গিয়ে কি যেন একটা প্রিয় জিনিস হারাতে যাচ্ছে মোনা। কি যেন একটা অপরাধ বোধে মোনা সংকুচিত হচ্ছে। কিন্তু তবুও তারপক্ষে কিছু করার নেই। মাঈনুলের সাথেই মোনার বিয়ে হবে। পাত্রপক্ষ আগেই বলেছিলো এখনি তারা মোনাকে বউ হিসেবে উঠিয়ে নিবে না। সেজন্য মোনার হাতে রিং পরিয়েই পাক্ষপক্ষ চলে যায়। এর ফাঁকে মোনা পরিহিত শাড়ি খুলে থ্রি পিছ গায়ে পরে। আজ থেকে মোনার নতুন জীবন শুরু হতে যাচ্ছে। নতুন মানুষের সাথে বেঁচে থাকার স্বপ্ন বুনন শুরু হতে যাচ্ছে। এদিকে শ্রাবণ তার অসুস্থ মাকে নিয়ে হসপিটালে পড়ে আছে। প্রিয় মানুষকে হারানোর ভয়ে পাহাড় সমান কষ্ট বুকে ধারণ করে শ্রাবণ তার অসুস্থ মায়ের পাশে বসে সেবা যত্ন করছে। মাকে শ্রাবণ ভীষণ ভালোবাসে। এমতাবস্থায় মোনা আবার শ্রাবণকে ফোন দিতে যায়। কয়েক বার ফোন দেওয়ার পর শ্রাবণকে পাওয়া গেলো।
শ্রাবণ : বলো...
মোনা : তোমার ফোনে ফোন যায় না কেন ? অনেক বার ট্রাই করার পর ফোনে তোমাকে পেলাম।
শ্রাবণ : হয়তো নেটওয়ার্কের সমস্যা তাই।
মোনা : ওহহহ আচ্ছা। তারপর বলো আন্টির এখন কি অবস্থা ?
শ্রাবণ : মা অনেকটাই সুস্থ এখন। কালকে বাসায় ফিরবো। পাত্রপক্ষ কি তোমাকে দেখতে আসছিলো ?
মোনা : হুমমম আসছিলো...
শ্রাবণ : কি হলো...
মোনা : তুমি বাসায় আসে তারপর বলবোনি।
শ্রাবণ : এখন বললে কি হবে ?
মোনা : আরে তুমি তর্ক করছো কেন ? বলার তো অনেক সময় আছে। আন্টিকে নিয়ে আগে তুমি বাসায় আসো তারপর একসাথে বসে বলি।
শ্রাবণ : আচ্ছা ঠিক আছে।
মোনা : এবার তাহলে ফোন রাখি।দেখে শুনে বাসায় এসো তাহলে...
শ্রাবণ : ওকে...
(চলবে...)
Website: www.ichchashakti.com E-mail: ichchashaktipublication@gmail.com