মানবজীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে স্বাস্থ্য। অথচ মানুষ নিজেই নানা কারণে, নানা আসক্তিতে নিজের স্বাস্থ্য ধ্বংসের পথ বেছে নেয়। এমনই এক ধ্বংসাত্মক ও মরণঘাতী আসক্তির নাম সিগারেট। এই ছোট্ট একটি বস্তু মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। তবুও বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ সিগারেট ধূমপান করছে, জেনেও যে এটি তাদের ফুসফুসকে পুড়িয়ে দিচ্ছে, হৃদপিণ্ড ধ্বংস করছে, পুরুষত্ব হরণ করছে এবং ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগ ডেকে আনছে।
সিগারেটের ভিতরের বিষ
সিগারেটে প্রায় ৭০০০টিরও বেশি রাসায়নিক পদার্থ থাকে। এর মধ্যে নিকোটিন, টার, কার্বন মনোক্সাইড, অ্যামোনিয়া, অ্যাসিটোন, আর্সেনিক, সায়ানাইড, ফর্মালডিহাইড প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে প্রায় ৭০টি উপাদান সরাসরি ক্যান্সারের জন্য দায়ী। নিকোটিন এমন একটি পদার্থ যা স্নায়ুকে প্রভাবিত করে এবং মানুষকে আসক্ত করে তোলে। ধূমপানের সময় নিকোটিন মস্তিষ্কে পৌঁছে এক ধরনের কৃত্রিম সুখের অনুভূতি তৈরি করে, যার ফলে মানুষ বারবার ধূমপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
হৃদরোগের প্রধান কারণ
সিগারেট হৃদপিণ্ডের প্রধান শত্রু। ধূমপান রক্তনালিকে সংকুচিত করে, ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায় এবং হৃদযন্ত্রকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কাজ করতে হয়। দীর্ঘদিন সিগারেট খেলে হৃদরোগ, হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকগুণ বেড়ে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ধূমপানকারীদের মধ্যে হৃদরোগে মৃত্যুর হার ধূমপান না করা মানুষের তুলনায় ২-৪ গুণ বেশি।
ক্যান্সারের কারখানা
সিগারেটকে বলা যায় ক্যান্সারের কারখানা। ফুসফুস ক্যান্সার, মুখ গহ্বরের ক্যান্সার, গলা ও কণ্ঠনালির ক্যান্সার, খাদ্যনালীর ক্যান্সার এমনকি প্যানক্রিয়াস ও কিডনির ক্যান্সারও সিগারেটের মাধ্যমে হতে পারে। একজন ধূমপায়ী যদি প্রতিদিন ২০টি সিগারেট ধূমপান করে, তবে তার ফুসফুস ধীরে ধীরে কালো হয়ে যায়, ভেঙে পড়ে এবং অক্সিজেন গ্রহণের ক্ষমতা কমে যায়।
প্রজননক্ষমতা ও পুরুষত্ব ধ্বংস
সিগারেট ধূমপান পুরুষদের প্রজননক্ষমতা হ্রাস করে। গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপানকারীদের শুক্রাণুর গুণমান হ্রাস পায়, সংখ্যা কমে যায় এবং দুর্বল হয়ে পড়ে। এতে সন্তান ধারণে সমস্যা হয় এবং বন্ধ্যাত্ব দেখা দেয়। এছাড়া, দীর্ঘদিন সিগারেট খেলে রক্ত সঞ্চালনের সমস্যার কারণে পুরুষত্ব হ্রাস পায়, যা সম্পর্ক ও পারিবারিক জীবনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলে।
নারী ও গর্ভবতী মায়েদের জন্য ভয়াবহ
নারীরাও এখন সিগারেটের শিকার হচ্ছেন। নারীদের ক্ষেত্রে সিগারেটের প্রভাব আরও বেশি বিপজ্জনক। গর্ভবতী নারীরা ধূমপান করলে গর্ভস্থ শিশুর জন্মগত সমস্যা, সময়ের আগেই শিশু জন্ম, ওজন কম হওয়া এবং এমনকি মৃত সন্তান জন্মদানের ঝুঁকি বাড়ে। এছাড়া, স্তন ক্যান্সার এবং জরায়ু ক্যান্সারের সম্ভাবনাও সিগারেটের কারণে বাড়তে পারে।
ধূমপানের পরোক্ষ শিকার
সিগারেট শুধু ধূমপানকারীর ক্ষতি করে না, তার চারপাশের মানুষদেরও ক্ষতি করে। এই ধরনের ধূমপানকে বলা হয় পরোক্ষ ধূমপান (Passive Smoking)। গবেষণায় দেখা গেছে, পরোক্ষ ধূমপানকারী ব্যক্তিদেরও ফুসফুসের সমস্যা, ক্যান্সার ও হৃদরোগ হতে পারে। শিশুরা এই ঝুঁকির মুখে সবচেয়ে বেশি পড়ে। একজন পিতা যদি ঘরে সিগারেট খান, তবে সন্তান তার ধোঁয়া শোষণ করে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি
সিগারেট শুধু শারীরিকভাবে নয়, আর্থিকভাবেও ধূমপায়ীকে নিঃস্ব করে দেয়। প্রতিদিন সিগারেট কেনার পেছনে যে টাকা খরচ হয়, তা বছরে একটি বড় অঙ্কে দাঁড়ায়। এই অর্থ সঞ্চয় করে পরিবার, শিক্ষা বা চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করা যেত। অনেক নিম্ন আয়ের মানুষ সিগারেটের জন্য খাবার বা ওষুধের টাকাও ব্যয় করে ফেলে, যা পরিবারে দারিদ্র্য আরও বাড়িয়ে তোলে।
সমাজ ও পরিবেশের ক্ষতি
সিগারেটের কারণে সমাজে মাদকাসক্তির প্রবণতা বাড়ে। ধূমপানকে gateway drug হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যার মাধ্যমে মানুষ ধীরে ধীরে গাঁজা, ইয়াবা, হেরোইন ইত্যাদির দিকে ঝুঁকে পড়ে। এছাড়া, সিগারেটের ধোঁয়া পরিবেশ দূষণ করে এবং সিগারেটের ফেলা অবশিষ্টাংশ যেমন ফিল্টার প্রকৃতিতে শত শত বছর টিকে থেকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর প্লাস্টিক দূষণ সৃষ্টি করে।
ধূমপান বন্ধের উপায়
ধূমপান ত্যাগ কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। সচেতনতা, মানসিক প্রস্তুতি এবং পরিবার ও বন্ধুদের সহযোগিতা এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি (NRT), কাউন্সেলিং, মেডিটেশন ও শারীরিক ব্যায়ামের মাধ্যমে ধূমপান ত্যাগ করা যায়। সরকার ও স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর সচেতনতামূলক উদ্যোগ, কর বৃদ্ধি, সিগারেটের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধকরণ এবং পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষেধাজ্ঞা—সবগুলো পদক্ষেপ একযোগে নেওয়া জরুরি।
উপসংহার
সিগারেট ধূমপান এক নীরব ঘাতক। এটি স্বাস্থ্যের ধ্বংস ডেকে আনে, পরিবারকে সংকটে ফেলে এবং সমাজকে দুর্বল করে তোলে। ধূমপান কখনোই স্টাইল নয়, বরং এটি ধ্বংসের সূচনা। আমাদের সবাইকে সিগারেটের বিরুদ্ধে সচেতন হতে হবে, নিজের এবং প্রজন্মের ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে হবে। মনে রাখতে হবে—জীবন একটাই, তা নষ্ট করার জন্য সিগারেট নয়, গড়ার জন্য সচেতনতা দরকার।
Website: www.ichchashakti.com E-mail: ichchashaktipublication@gmail.com