—আবির মাহফুজ
২০২৪ সালের জুলাই মাস। মেঘলা আকাশের নিচে ঝাঁঝালো একটা বাতাস তখন বাংলাদেশের বাতাসে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছু একটা ঘটবে, ঠিক যেন ঘূর্ণিঝড়ের আগমুহূর্তের নিস্তব্ধতা। অবশেষে ঘটেও গেল--যা ইতিহাসে জায়গা করে নিল ‘জুলাই বিপ্লব’ নামে।
হাইকোর্টের এক রায় ৫ জুন ঘোষণা করল, মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল করা হবে। অনেকের চোখে এটি ছিল একটি “গৌরবের” সিদ্ধান্ত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কাছে এটি ছিল অন্যায্য, বৈষম্যমূলক। তারা চায় মেধার ভিত্তিতে চাকরি, কোটার নামে অনিয়ম নয়। শহর থেকে শহরতলি, ক্যাম্পাস থেকে ক্যাম্পাস--শুরু হলো এক সুশৃঙ্খল, অহিংস প্রতিবাদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ছেলেমেয়েরা পোস্টার হাতে দাঁড়ায়। তারা বলে--“আমরা শুধু আমাদের প্রাপ্যটা চাই।” ৭ জুলাই থেকে শুরু হওয়া এ আন্দোলন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। জয়পুরহাট, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও জ্বলে ওঠে প্রতিরোধের আগুন।
কিন্তু সরকার এই দাবিকে কণ্ঠরোধ করতে চায় শক্তির মাধ্যমে। ১০ জুলাই শাহবাগ অবরোধ করা হলে পুলিশের টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট শুরু হয়। তারপরও ছাত্ররা পিছু হটে না। বরং তারা নিজেরাই গঠন করে চিকিৎসা ইউনিট, সংবাদ প্রচার টিম। পত্রিকার হেডলাইন না হলেও ফেসবুক-টেলিগ্রামে ভাইরাল হয়ে ওঠে একেকটি প্রান্তিক ছাত্রের কণ্ঠস্বর।
১৫ জুলাই পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়। সেদিন রাতে ঢাবি, জগন্নাথ, কুমিল্লা, চুয়েট, খুলনা--যেখানেই আন্দোলন, সেখানেই ছাত্রলীগ ও পুলিশ একযোগে হামলা চালায়। বহু শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন, কিছু শিক্ষার্থীর খোঁজ মেলেনি আজও।
১৬ জুলাই ভোর। ঢাবির টিএসসি, রোকেয়া হল, শাহবাগ, সায়েন্স ল্যাব--
সবখানে গুলির শব্দ। কেউ কাঁদে, কেউ দৌড়ায়, কেউ গুলি খেয়ে পড়ে থাকে নিথর। শুধু ছাত্র না, মেয়ের খোঁজে আসা এক মা-ও আহত হন পুলিশের লাঠিচার্জে। গণমাধ্যম চুপ--কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া ফেটে পড়ে--এই কি স্বাধীনতার ফসল?”
একই দিনে বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট। কারেন্ট অফ, ওয়াইফাই অফ, কিন্তু ছাত্রদের মনের আগুন অফ হয় না। তারা মোমবাতি জ্বালিয়ে, সড়কের ওপর শুয়ে, শহীদদের নাম ধরে ধরে প্রতিবাদ চালিয়ে যায়।
২০ জুলাই থেকে ‘অসহযোগ আন্দোলন’ শুরু হয়। কেউ অফিসে যায় না, কেউ ক্লাসে ফেরে না। হাসপাতাল ছাড়া সব কিছু অচল। শহরের বাস ডিপোতে চালকেরা বলে, “এই ছেলেমেয়েরাই আমাদের আগামী, আজ তাদের জন্যই চাকা থামুক।”
পুলিশ, প্রশাসন, ছাত্রলীগ যখন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, তখন সাধারণ মানুষ এসে দাঁড়ায় ছেলেমেয়েদের পাশে। বাজারের দোকানদার, রিকশাওয়ালা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক--সবাই এক কণ্ঠে বলে, “এটা আর শুধু কোটা নয়, এটা ন্যায়ের লড়াই।”
৫ আগস্ট, সেই ঐতিহাসিক দিন। ভোরবেলা হেলিকপ্টারে ঢাকা ত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী। টানা প্রতিরোধের মুখে ক্ষমতা হস্তান্তর হয় এক নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার হাতে। ৩০০-এর বেশি ছাত্রছাত্রী নিহত, হাজার হাজার আহত, শতাধিক নিখোঁজ--তবুও হাসছে না কেউ। কারণ জয় এল খুব দেরিতে, আর অনেক বেশি দামে।
এই বিপ্লব ছিল নিঃশব্দ মানুষের গর্জন। কারও কাছে এটি ছিল ‘বিদ্রোহ’, কারও কাছে ‘গণজাগরণ’, আর কারও কাছে ‘একটি জাতির আত্মার উত্থান’। কিন্তু সবার উপরে এটি ছিল--সত্যের জয়গাথা’।
এই গল্প কোনো রূপকথা নয়, কোনো গালগল্প নয়। এটি ইতিহাস, এটি আমাদের সময়, এটি আমাদের সন্তানদের গর্বের বর্ণনা।
আমরা বলবো, “তোমরা যাদের গুলি করেছিলে, তারাই আজ ইতিহাস হয়ে গেল।”
Website: www.ichchashakti.com E-mail: ichchashaktipublication@gmail.com