ইরাকের গ্রীষ্ম অনেকটা আমাদের দেশের বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের মতই—তপ্ত, রুক্ষ আর কষ্টকর। বালির ঝড়ে চারদিক ধূসর হয়ে যায়, মাঝে মাঝে মনে হয় পৃথিবীটাই যেন থেমে গেছে। অথচ, এই উত্তপ্ত বালুর বুকেই আমি আজ তিন বছর ধরে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি। এই পথচলার পেছনে যে শক্তি, তা হলো আমার বাবার আদেশ।
আমার নাম মাসুদ রানা। রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ থানার দৌলতদিয়া ইউনিয়নের ছোট্ট গ্রাম—জলিল সরদারপাড়া আমার জন্মস্থান। আমি আমাদের পরিবারের ছোট ছেলে। বড় ভাই দেশে ব্যবসা করে ছোট্ট , মা-বাবা গ্রামেই। আমাদের পরিবারটা খুব সাধারণ, কিন্তু আদর্শে গড়া। বাবার কাছে শিখেছি, “সত্যর উপর হাঁটলে পথ কঠিন হয় ঠিকই, তবে শেষমেশ জয় হয়।”
প্রবাসে পা রাখার আগে দিনগুলো ছিলো অস্থিরতায় ভরা। গ্রামে কাজের সুযোগ ছিলো না, আর শহরে গিয়ে চাকরি খুঁজেও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতাম। বাবার মুখের দিকে তাকাতে পারতাম না। তখন একদিন বাবা বললেন,
“দেখ মাসুদ, আমরা গরিব, কিন্তু আমাদের আত্মসম্মান আছে। অন্যায়ের সাথে কখনো আপোস করিস না। প্রবাসে যাবি ঠিক আছে, কিন্তু মনে রাখিস—অসৎ পথে চলবি না। অসৎ টাকায় সংসার চলে না, বরং সংসার নষ্ট হয়। সৎভাবে জীবন কাটাতে পারলে তবেই শান্তি পাস।”
এই কথাগুলো আমার জীবনের পথনির্দেশ হয়ে গেল। তখনই সিদ্ধান্ত নেই—আমি প্রবাসে যাবো, কিন্তু শুধু হালাল উপার্জনের জন্য, সম্মান নিয়ে বাঁচার জন্য।
বিদায়বেলার কান্না
ইরাকে আসার আগে বিদায়ের মুহূর্তটা এখনো চোখে ভাসে। মা আমাকে বুকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন, আর বাবা শুধু বলেছিলেন,
“মাথা নত করিস না কারো অন্যায়ের কাছে, আল্লাহর উপর ভরসা রাখ।”
আমি বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর থেকেই জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো। প্রথম কয়েক মাস অদ্ভুত এক মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে কাটিয়েছি। ভাষা জানি না, সংস্কৃতি অজানা, খাওয়া-দাওয়ায় ভিন্নতা, ঘুম হয় না। এমন অবস্থায় মাঝে মাঝে নিজেকে খুব দুর্বল লাগতো।
কিন্তু বাবার সেই কথাগুলো বুকের ভেতর এক শক্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো—“সৎ পথে চল, ধৈর্য ধর, আল্লাহতালা ঠিকই পথ দেখাবেন।”
প্রথম কাজের কষ্ট
প্রথম যে কাজে লাগলাম, সেটা ছিলো নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে। সকাল সাতটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত পাথর, ইট, বালি টানাটানি। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে কাজ করে হাতের তালু ফেটে রক্ত বের হতো। তখন বুঝলাম, রুটি-রুজির জন্য মানুষের কতটা সংগ্রাম করতে হয়।
অনেকেই বলতো, “চল, একটু শর্টকাট পথে টাকা রোজগার করি। কাজের ভিতরে কাজ, একটু ফাঁকি দিলেও চলে। মালিক বোঝে না।”
কিন্তু আমি পারিনি। বাবার আদেশ আমাকে বাঁধা দিতো। আমি জানতাম, অসৎ উপার্জনে যে টাকা আসে, তা আশীর্বাদ হয় না—বরং অভিশাপ হয়ে ফিরে আসে।
বন্ধু নির্বাচনেও সতর্কতা
প্রবাসে অনেক রকম মানুষ থাকে। কেউ ভালো, কেউ ধূর্ত। একবার এক বাংলাদেশি সহকর্মী আমাকে বলল, “ভাই, এসব কষ্ট করে কী হবে? একটু বুদ্ধি করে চললেই দেখবেন, মাসে অতিরিক্ত ৫০-৬০ ডলার বেশি রোজগার করবেন।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কীভাবে?”
সে বলল, “এই-সেই, ছোটখাটো জিনিস বাইরে বিক্রি করে দেই, মালিক টের পায় না।”
আমি সোজা না করে দিলাম। মনে পড়লো বাবার কথা—“অসৎ টাকা কখনো পকেটে আনবি না। এমন বন্ধু বানাবি না যারা তোর সৎ পথে বাধা হবে।”
তারপর থেকে খুব সাবধানে বন্ধুত্ব করেছি। এখন আমার কয়েকজন ভালো বন্ধু আছে, যারা সত্যিই কঠোর পরিশ্রম করে, একে অপরকে সহায়তা করে, বিপদে পাশে দাঁড়ায়।
পরিবারের ভালোবাসা: প্রেরণার উৎস
প্রবাসজীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি আমার পরিবার। রোজ রাতে মা ফোনে দোয়া করেন, বাবার মুখের শান্ত কণ্ঠ শুনে আমি আবার শক্তি পাই।
মাঝে মাঝে ছোট বোন বলত, “ভাইয়া, তুমি না আসলে ঈদে মন ভালো লাগে না।”
তখন বুকটা কেঁপে ওঠে, চোখ ভিজে যায়। তবু নিজেকে শক্ত করে বলি, “এখন কষ্ট করছি, যেন ভবিষ্যতে তোর স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পারি।”
ধৈর্যের ফল
তিন বছর হতে চলল—আমি আজ একজন অভিজ্ঞ শ্রমিক। কাজের অভিজ্ঞতা, সততা ও সময়নিষ্ঠার কারণে এখন মালিক আমার উপর ভরসা করেন। মাসে এখন আগের চেয়ে বেশি বেতন পাই। কিছু টাকা সঞ্চয় করেছি। বাড়িতে মা-বাবার জন্য নতুন টিনের ঘর তুলেছি, বোনের পড়াশোনার খরচ চালাচ্ছি।
একটা সময় ছিলো, যখন গ্রামের মানুষ আমাকে বলতো, “ওরে! কী করবি প্রবাস গিয়ে?” আজ সেই মানুষরাই বলে, “তুই আদর্শ ছেলে, তোর বাবার মতোই সৎ।”
আল্লাহর উপর ভরসা
প্রবাসজীবনে অনেকেই হতাশায় ডুবে যায়, কেউ কেউ ভুল পথে পা বাড়ায়। কিন্তু আমি বুঝেছি—আল্লাহ যার জন্য যা নির্ধারণ করেছেন, ধৈর্য ও পরিশ্রম করলে সে ঠিকই তার লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে।
একদিন কাজ শেষে রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে দোয়া করলাম—
“হে আল্লাহ, আমার বাবা-মার মুখে হাসি রাখুন। আমাকে সৎ পথে রাখুন, যেন কোনোদিন তাঁদের মুখের দিকে লজ্জায় না তাকাতে হয়।”
শেষ কথা: বাবার আদেশই আমার জীবনদর্শন
আজ আমি যেখানে আছি, যা কিছু অর্জন করেছি, তার পেছনে মূল ভিত্তি—আমার বাবার আদেশ। সেই ছোটবেলায় শোনানো কথাগুলো আমার পথের দিশা হয়েছে।
“অন্যায়ের পথে কখনো পা বাড়াবা না, অন্যায়কে মাথা নত করবা না। সৎ পথে চলবা, অসৎ টাকা হাতে আনবি না। এমন বন্ধুবান্ধব বানাবি না, যারা তোর চরিত্র নষ্ট করবে। তাহলেই প্রবাসজীবনে সুখে থাকবি, ধৈর্য ধরবি, আল্লাহতালা ঠিকই গন্তব্যে পৌঁছে দেবে।”
এই কথাগুলোই আমার জীবনের মূলমন্ত্র।
আমি মাসুদ রানা, রাজবাড়ী জেলার জলিল সরদারপাড়ার সন্তান। আজ আমি গর্ব করে বলতে পারি—আমি প্রবাসে আছি ঠিকই, কিন্তু মাথা নত করিনি। বাবার আদর্শে চলছি, সৎ পথে জীবন গড়ছি। আর এই পথেই আমি খুঁজে পেয়েছি জীবনের সত্যিকার অর্থ।