ভূমিকা :
বাংলাদেশের ইতিহাসে কম্পন সৃষ্টিকারী এক আন্দোলনের নাম জুলাই বিপ্লবের আন্দোলন। বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করার দাবিতে আন্দোলনের সুত্রপাত ঘটে ঐতিহাসিক জুলাই আন্দোলনের। আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হলেও কয়েকদিনের মধ্যে এটি সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। তারই ধারাবাহিকতায় বরিশালে ৯ জুন সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজকে কেন্দ্র করেই শুরু হয় বরিশালের জুলাইয়ের আন্দোলন।
বরিশালে জুলাইয়ের আন্দোলন ও সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। কারণ বরিশাল শহরের আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল বিএম কলেজ। বিএম কলেজের নেতৃত্বে নগরীর সৈয়দ হাতেম আলি কলেজ,পলিটেকনিক, অমৃত লালদে কলেজ, মহিলা কলেজ, বরিশাল সরকারি কলেজ, বরিশাল জিলা স্কুল সহ নগরীর অন্যান্য সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বরিশালে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থান নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল চত্বরে আন্দোলনের কর্মসূচি গুলো বাস্তবায়ন করা হয় পাশাপাশি নগরীর চৌমাথা,রুপাতলিতেও একই কর্মসূচি বাস্তবায়ন হয়। অপরদিকে বরিশালের একমাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় “বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়” বরিশাল নগরী থেকে দূরবর্তী অবস্থানে হওয়ায় তারা তাদের প্রথম ও মধ্য দিকের সকল কর্মসূচি তাদের ক্যাম্পাসের সম্মুখে ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করে পালন করে এবং পরবর্তীতে সর্বশেষ কর্মসূচি গুলোতে নগরীর আন্দোলনের সাথে এসে যোগদান করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
নিম্নে বরিশালের জুলাই আন্দোলন ২০২৪ ও সরকারি ব্রজমোহন কলেজ নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।
বরিশালে জুলাই আন্দোলনের ঘটনা প্রবাহ:
বরিশালে জুলাই আন্দোলনের সূচনা : ২০১৮ সালে কোটা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে পাস হওয়া পরিপত্র মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করলে তা পূর্ন বহালের দাবিতে ২০২৪ সালের ৫ জুন ঢাবি থেকে সর্বপ্রথম এই আন্দোলন শুরু হয়ে তা সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পরে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সর্বপ্রথম ০৯ জুন বরিশাল বিএম কলেজকে কেন্দ্র করে বরিশালে জুলাই আন্দোলনের সুত্রপাত ঘটে।
জুন মাসে আন্দোলনের সূচনা ঘটলেও এরপর ঈদ ও গ্রীষ্মকালীন ছুটির কারণে আন্দোলন স্থগিত থাকে শিক্ষার্থীরা বাড়ি চলে যায় এবং ফিরে এসে মূল আন্দোলন শুরু হয় জুলাইতে।
জুলাইতে এসে শিক্ষার্থীরা সারা দেশ ব্যাপি সংগঠিত হয়ে আন্দোল
ন শুরু করে দেয়। শুরু হয়ে যায় জুলাইয়ের সেই ঐতিহাসিক আন্দোলনের যাত্রা। তারই ধারাবাহিকতায় ৩ জুলাই বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা “সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ,সরকারি বিএম কলেজ,বরিশাল” এই ব্যানারে সরকারি চাকুরিতে ২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিল করে কোটা পদ্ধতি পূর্ন বহাল সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ের প্রতিবাদ চাকুরিতে মেধাভিত্তিক নিয়োগ বহাল রাখার দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করে। এর মাধ্যমেই শুরু হয়ে যায় বরিশাল শহরের ঐতিহাসিক জুলাইয়ের আন্দোলন। বরিশালে ধ্বনিত হতে থাকে “কোটা না মেধা মেধা মেধা“,” আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাই নাই”,” জেগেছে রে জেগেছে ছাত্রসমাজ জেগেছে লেগেছে রে লেগেছে রক্তে আগুন লেগেছে “। এর পর একে একে কেন্দ্রের সাথে তালমিলিয়ে ধারাবাহিক কর্মসূচি গুলো শুরু হয়।
অবস্থান কর্মসূচি ও বাংলা ব্লকেড :
৭ থেকে ১০ জুলাই চলে অবস্থান কর্মসূচি ও বাংলা ব্লকেড ।
৭ জুলাই বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস থেকে সংগঠিত হয়ে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বরিশাল কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল চত্বর অবরোধ করে অবস্থান করে আন্দোলন শুরু করে দেয়। এই দিনের আন্দোলনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আরো সংগঠিত হওয়া শুরু করে। পূর্বের কর্মসূচি থেকে এই দিনের কর্মসূচিতে আরো কয়েকগুণ শিক্ষার্থী বৃদ্ধি পায়। এরপর ৯ জুলাই মঙ্গলবার সকল গ্রেডের কোটা বাতিলের এক দফা দাবিতে নামে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থী কলেজ থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে গিয়ে নথুল্লাবাদ অবস্থান করে ব্লকেড করে দেয়। এর মাধ্যমে দক্ষিণ অঞ্চলের সাথে সারা দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আন্দোলন তিব্রতর হয়। এবার পূর্বের কর্মসূচি থেকে আরো কয়েকগুন শিক্ষার্থী বেরে যায়। গোটা নথুল্লাবাদ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পদচারণায় কম্পিত হতে থাকে। ঐদিন শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে বিভিন্ন খেলায় মেতে উঠে কেউ কেউ আবার সড়কে বসেই বই খুলে পড়তে বসে। এরপর দিন ১০ জুলাই বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা সকল গ্রেডের অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লেখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে নূন্যতম মাত্রায় এনে সংসদে আইন পাস করে কোটা পদ্ধতিকে সংস্কারের ১ দফা দাবিতে সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্নক “বাংলা ব্লকেড” কর্মসূচি পালন করে। এই দিন বরিশাল কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল নথুল্লাবাদকে ব্লকেড করে পুরো দক্ষিণ অঞ্চলকে অচল করে দেয় শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন স্লোগানে প্রকম্পিত হয় নথুল্লাবাদ। এভাবেই বরিশালে চলে জুলাই আন্দোলনের সেই ঐতিহাসিক বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি।
গণপদযাত্রা এবং স্মারকলিপি প্রদান :
১৪ জুলাই সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলো সরকারি চাকরির সকল গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে কোটা পদ্ধতির সংস্কার করার এক দফা দাবিতে একযোগে সারা বাংলাদেশ থেকে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান কর্মসূচি পালন করে। তারই ধারাবাহিকতায় বিপ্লবী শিক্ষার্থীরা বিএম কলেজ থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে গণপদযাত্রা করে বরিশাল জেলাপ্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়ে জেলাপ্রশাসকের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি হস্তান্তর করে।
দেশের প্রথম স্বাধীন ক্যাম্পাস:
১৬ জুলাই দিনটি বরিশালের জুলাই আন্দোলনের ইতিহাসে, বিএম কলেজের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক স্মরণীয় দিন হিসেবে রচিত হয়। ১৬ জুলাইয়ের আগের দিন থেকেই স্বৈরাচারী আওয়ামী সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের নানা ভাবে হুমকি দিতে থাকে যাতে আন্দোলন বাধাগ্রস্ত করতে পারে। ১৬ জুলাই কর্মসূচির আগের দিন রাতেই আওয়ামী সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে বিএম কলেজে অবস্থান করার হুমকি দেয়। কিন্তু তাতে দমে যায়নি বিএম কলেজের অকুতোভয় বিপ্লবী সৈনিকরা তারা আওয়ামী সন্ত্রাসীদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ১৬ তারিখের কর্মসূচিতে নামে।
ঢাবি,চবি,জাবি সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সারাদেশে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে এবং কোটা পদ্ধতির যৌক্তিক সংস্কারের ১ দফা দাবি আদায়ে বিক্ষোভ সমাবেশ ও অবস্থান কর্মসূচির ব্যানারে তারা নথুল্লাবাদ অবস্থান নেয়। পাশাপাশি নগরীর সৈয়দ হাতেম আলি কলেজ,পলিটেকনিক,সরকারি বরিশাল কলেজ,অমৃত লালদে কলেজ মহিলা কলেজ,জিলা স্কুল সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বিএম কলেজের সাথে নথুল্লাবাদ চত্বরে অবস্থান নেয়। বরিশালের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিপ্লবীদের অংশগ্রহণে নথুল্লাবাদ জনসমুদ্রে পরিনত হয়। বিপ্লবীদের প্রতিবাদী কন্ঠস্বরে প্রকম্পিত হয় নগরী। স্লোগান স্লোগানে প্রতিবাদ করা হয় শিক্ষার্থীদের সাথে হওয়া অন্যায়ের। ১৪ জুলাই হাসিনা শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে রাজাকার বলায় তার প্রতিবাদে সেদিনও ধ্বনিত হয় “ তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার”,”চেয়েছিলাম অধিকার হয়ে গেলাম রাজাকার” এরকম অনেক স্লোগানে কম্পিত হয় বরিশাল। এদিকে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা তাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বিএম কলেজ ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে অস্ত্রসস্ত্রসহ মহড়া দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর হামলে করে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আহত করে। এই খবর মূহুর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পরে। নথুল্লাবাদ অবস্থানরত বিপ্লবী শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের হামলার খবর শুনে, নথুল্লাবাদে তাদের একাংশ রেখে অপরাংশকে নিয়ে বিএম কলেজের ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করে বিএম কলেজকে ফ্যাসিবাদ মুক্ত স্বাধীন করতে রওনা দেয় বিএম কলেজ ক্যাম্পাসে। অতঃপর বীরদর্পে বিএম কলেজের সাথে সৈয়দ হাতেম আলি কলেজ, পলিটেকনিক,বরিশাল সরকারি কলেজ, অমৃতলালদে কলেজ,জিলা স্কুল সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিপ্লবীরা সম্মিলিত ভাবে ক্যাম্পাসে ঢুকে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের ধাওয়া দেয়। শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পরে কেউ পুকুরে ঝাপ দেয় কেউ আবার মসজিদে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এরপর শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে তৎকালীন বিএম কলেজের অধ্যক্ষের উপস্থীতিতে বিএম কলেজ থেকে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এভাবেই শিক্ষার্থীরা পুরো বিএম কলেজ ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করে দেশের প্রথম স্বাধীন ক্যাম্পাস হিসেবে বিএম কলেজ গৌরব অর্জন করে।
এই ঘটনা মূহুর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পরে সারা দেশ ব্যাপি এবং সারা দেশের শিক্ষার্থীরা বরিশালের বিপ্লবের বীরত্বের কথা শুনে আরো উদ্ভুদ্ধ হয়। এবং ঐদিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা ৪৩ জন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও অজ্ঞাতনামা আরো ১৮০ জনের নামে মামলা দেয়। ঐদিন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জুলাইয়ের বীর আবু সাঈদ স্বৈরাচারী প্রশাসনের দিকে দুহাত প্রসারিত করে দিয়ে শহীদ হন। সেই দৃশ্য পুরো দেশকে কাঁদিয়েছিল। তখন তার বেদনার ক্ষোভে আন্দোলন আরো বেরে যায় শিক্ষার্থীরা আরো ফুসে উঠে।
কমপ্লিট সাট ডাউন : শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের উপর পুলিশ, বিজিবি,র্যাব,সোয়াটের ন্যাক্কারজনক হামলা,খুনের প্রতিবাদ,খুনের বিচার, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত কোটা সংস্কারের এক দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা মাঠে নামে। ঐদিন বরিশালের ইতিহাসে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন ছিল। স্বৈরাচারী হাসিনা যখন একের পর এক ছাত্র হত্যা করেও ছাত্রদের দমাতে পারেনি তখন সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুলোতে প্রশাসন মোতায়ন করে দেয়। তারই ধারাবাহিকতা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় বিজেপি,এপিএন,সোয়াট এর যৌথ বাহীনি ছাত্রদেরকে ক্যাম্পাস ছাড়া করার জন্য রাবার বুলেট দিয়ে হামলা শুরু করে। ছাত্ররা সেই হামলায় দমে যায়নি তারা প্রশাসনের বিরুদ্ধে সাথে লাঠি সোটা ইট পাটকেল দিয়ে লড়াই চালিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং আশেপাশে গ্রামের লোকজন তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে এবং তাদের সাথে সেদিন বিএম কলেজের ছাত্রাও প্রতিরোধে অংশগ্রহণ করে। অতঃপর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের প্রতিরোধের মুখে প্রশাসন মুচলেকা দিয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে বাধ্য হয়। বরিশালের এই ঘটনা পুরো দেশবাসীকে অবাক করে দেয়। সেদিন ঢাকায় আর একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে,আন্দোলনকারীদেরকে মেয়ের মুগ্ধ পানি খাওয়াতে গিয়ে সেদিন শহীদ হয়।” ভাই পানি লাগবে পানি” আন্দোলনকারীদের পানি খাওয়ানোর সেই মুহূর্তে তার মাথায় এসে লেগে স্বৈরাচারির বুলেট এবং সে শহীদ হন। এই ঘটনা দেখে কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি দেশবাসী আরো ক্ষোভে ফুসে উঠে । সেদিনই স্বৈরাচারী সরকার ক্ষোভে ফুসে উঠা ছাত্রজনতার আন্দোলন দমাতে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়।
মার্চ ফর জাস্টিস: দেশব্যাপি স্বৈরাচারী সরকারের ছাত্রজনতার উপর গণহত্যা,গণগ্রেপ্তার, হামলা মামলা, গুম এবং খুনের প্রতিবাদে জাতিসংঘ কতৃক তদন্তপুর্বক বিচারের দাবি এবং ছাত্র সমাজের নয় দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে দেশের সকল আদালত প্রাঙ্গনে ন্যায় বরিশালের আদালত প্রাঙ্গণ অভিমুখে ৩১ জুলাই বুধবার মার্চ করে বরিশালের শিক্ষার্থীরা। পুলিশ সেদিন বরিশালের শিক্ষার্থীদের উপর ন্যাক্কার জন্য হামলা চালায়, লাঠিচার্জ করে এমনকি প্রশাসনের লাঠিচার্জের রেহাই পাইনি নারী শিক্ষার্থীরাও। সেদিন পুলিশের লাঠি চার্জে অনেকে আহত হয়। এবং আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী কয়েকজন ছাত্রনেতাকে পুলিশ ধরে যায় পরবর্তীতে প্রতিবাদের মুখে থানা থেকে তাদের সন্ধ্যার মধ্যে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
আন্দোলনের নতুন মোর : দীর্ঘ ১ মাসের জুলুম-অত্যাচার,
গুম,খুন,ইন্টারনেট ব্লাক আউট করে গনহত্যা ; এ যেন সংঙ্গাহীন এক নির্মম ভয়াবহ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার ভিতর দিয়ে পার করছিল প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ ও তার জনগন। আন্দোলন দমনের জন্য সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া, ইন্টারনেট ব্লাক আউট করে গনহত্যা, কেন্দ্রীয় ৬ সমন্বয়ককে ডিবিতে নিয়ে অত্যাচার করে আন্দোলন প্রত্যাহারের জোর পূর্বক বিবৃতি কিছুই দমাতে পারেনি স্বৈরাচারী হাসিনার জুলুম-অত্যাচার, গনহত্যায় নিপিড়ীত ছাত্রজনতা। তারা বলেছিল সামনে আসছে ফাগুন আমরা হবো দিগুণ ; সেই দিগুণ হয়েই তারা আবার আগষ্টে মাঠে নামা শুরু করে। এবার আন্দোলনে যোগ দেয় দেশের সকল পেশার মানুষ। রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে শিল্পী, নায়ক,গায়ক,অভিনেতা, আলেমসমাজ, সাংবাদিক, অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মকর্তা, শিক্ষক সমাজ, বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসী সহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষ। তখন এই নির্মম জুলুম অত্যাচার দেখে কেউ আর ঘরে বসে থাকতে পারেনি মায়েরাও চলে এসেছিল সেদিন রাজপথে। তারই ধারাবাহিকতায় বরিশালেও তখন উত্তপ্ত পরিস্থিতি আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা একেরপর এক হুমকিধামকি অস্ত্রসহ নিয়ে শোডাউন দিয়ে ছাত্র জনতাকে দমানোর জন্য তাদের সকল চেষ্টা করতে থাকে। প্রশাসন ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা বাসায় বাসায় আন্দোলনকারী ছাত্রদের খুজতে থাকে। তখন ছাত্রজনতা বুঝতে পারে এই লড়াই এখন তাদের মরা বাঁচার লড়াই। তাই তারাও সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করার জন্য মাঠে নামে।
তখনকার রচিত একটি কবিতা
আমায় ডাকছে মাতৃভূমি
আজিজুল হাকিম সামি
সময় এসেছে রুখে দাড়াবার
তরুণ তুমি জাগো আবার।
বায়ান্ন তোমায় ডাকছে দেখো
তারাতারি চোখ খুলো
বিপ্লবীরা নিতে এসেছে তোমায়
তাড়াতাড়ি দোর খুলো।
একাত্তর আজ বাজিয়েছে দামামা
করতে স্বাধীন দেশ।
বসে থাকার সময় নাই আর
মাতৃভূমি আজ করেছে আদেশ।
হে তরুণ আজ রুখে দাও তুমি
স্বৈরাচারীর কালো হাত,
আমার মাতৃভূমি যেন মুক্ত হয়
না পায় যেন আর কোন আঘাত।
সারাদেশে গনহত্যা এবং গনগ্রেফতার এবং শিক্ষক সাংবাদিক ও সাধারন শিক্ষার্থীদের উপর হামলার প্রতিবাদে এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির আদায়ের লক্ষ্যে সারাদেশে জুমা নামাজ শেষে ছাত্রজনতার গনমিছিলের কর্মসূচির সাথে মিল রেখে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে বরিশালে বিএম কলেজ কেন্দ্রীয় মসজিদে জুমার নামাজ শেষে ছাত্রজনতার গনমিছিল বের করা হয়। ঐদিন যাতে বায়তুল মোকাররম থেকে ছাত্রজনতা গনমিছিল বের করতে না পারে তাই জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমকে স্বৈরাচারী হাসিনা যেভাবে প্রশাসন দিয়ে বেরিকেট দিয়ে রেখেছিল তখন সেই দৃশ্য দেখে মনে হয়েছিল এযেন এক খন্ড ফিলিস্তিন যেখানে ইসরায়েলী বাহিনী বায়তুল মুকাদ্দাসকে যেভাবে ঘিরে রাখে।
অসহযোগ আন্দোলন ও হাসিনার পতন: ৩ আগষ্ট, সারা দেশে ছাত্রজনতার শান্তিপূর্ন সমাবেশে হামলা প্রতিবাদে সারা দেশ ব্যাপি বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচি হয় তারই ধারাবাহিকতায় বরিশালেও বরিশালের সকল শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন গড়ে তুলে। ঐদিন বরিশালের পথঘাট সব কিছু ছাত্রজনতার পদচারণায় প্রকম্পিত হয়। এবং ঐদিন বিকেলে ঢাকা শহিদ মিনার থেকে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পদত্যাগের ১ দফা দাবি ঘোষণা করা হয়। তারপর ৪ আগষ্ট থেকে শুরু স্বৈরাচারী হাসিনার পদত্যাগের ১ দফা দাবি, ঐদিন সারা দেশের ন্যায় বরিশালেও খুব ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। প্রশাসনের সাথে সাথে আওয়ামী সন্ত্রাসীরাও প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মাঠে নামে । শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পথে পথে বিভিন্ন রাস্তার মোরে মোরে অস্ত্রসহ মহড়া আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। বিগত দিনের চেয়ে সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর দিন ছিল ৪ আগষ্টের হাসিনার পদত্যাগের ১ দফা দাবির আন্দোলনের দিনটি। দফায় দফায় বিভিন্ন স্থানে প্রশাসন ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের সাথে শিক্ষার্থীদের সাথে সংঘর্ষ হয়। ঐদিন নগরীর চৌমাথায় ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হয় পুলিশ ছাত্রদের উপর হামলা চালায় এবং দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। অনেক শিক্ষার্থী রাবার বুলেট বিদ্ধ হয়, আহত হয়। ঐদিনের পরিস্থিতি ছিল বরিশালের আন্দোলনের সবচেয়ে ভয়ংকর দিন। ঐদিন একসাথে কাঁধে কাধ মিলিয়ে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করেছিল বিএম কলেজ,বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, সৈয়দ হাতেম আলি কলেজ,শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ,বরিশাল সরকারি কলেজ,অমৃত লালদে কলেজ,মহিলা কলেজ,জিলা স্কুল,আলেকান্দা কলেজ সহ বরিশালের অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠান।
অবশেষে সারাদিন আন্দোলন শেষে কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের কাছ থেকে ঘোষণা আসে মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচির। ঐদিন অনেকে ঢাকা চলে যায়। আর বরিশাল শহরকে স্বৈরাচারীদের থেকে রক্ষার জন্য বরিশালে ছাত্রজনতা স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন অব্যাহত রাখে। অবশেষে মহান আল্লাহ তায়ালার অশেষ কৃপায় ৫ আগষ্ট ছাত্রজনতা হাসিনার পতন ঘটায়, হাসিনা পালিয়ে যায় ছাত্রজনতা গনভবন দখল করে। এভাবেই জুলাই আন্দোলনে ছাত্রজনতার বিজয় অর্জিত হয়।
বরিশালের জুলাই আন্দোলনে বিএম কলেজের ভূমিকা : বরিশালের জুলাই আন্দোলনের কেন্দ্র ও নেতৃত্বে ছিল বিএম কলেজ। তাদের অকুতোভয় সাহস আর নেতৃত্বে বরিশালে জুলাই আন্দোলন গড়ে উঠে এবং আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করে। বরিশাল বিএম কলেজে শিক্ষার্থী তাহিদুল ইসলাম জুলাই আন্দোলনে ঢাকায় অংশগ্রহণ করে শহিদ হন। ২৪ এর জুলাই আন্দোলন বরিশালের শিক্ষার্থীদের ভূমিকা অনেক এবং বরিশালের জুলাই আন্দোলনে বরিশাল বিএম কলেজ অসামান্য অবদান রেখেছে।
উপসংহার: সর্বপরি ২৪ এর জুলাই আন্দোলনে সারা বাংলাদেশের ভিতর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সরব একটি শহর ছিল বরিশাল। জুলাইয়ে ছাত্রজনতার অভ্যূত্থানে বরিশালের ছাত্রজনতার ভূমিকা অপরিসীম। এবং বরিশালের জুলাইয়ের আন্দোলনে বিএম কলেজের অবস্থান ছিল অবিস্মরণীয়।
লেখক পরিচিতি :
আজিজুল হাকিম সামি
সরকারি বিএম কলেজ, বরিশাল।