1. admin@ichchashakti.com : admin :
শনিবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:১৪ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
কুড়িগ্রামের লেখিকা নিপা’র কিছু কবিতাংশ “স্বপ্নের ছোঁয়া সাহিত্য পুরস্কার-২০২৫” এ শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জিতলো ‘চা জগত’ – বই  সাহিত্য আড্ডা ও সাফারি পার্ক ভ্রমণ ২০২৫ ইচ্ছাশক্তি সাহিত্য পরিবার আয়োজিত সাহিত্য আড্ডা ও সাফারি পার্ক ভ্রমণ ২০২৫ ইচ্ছাশক্তি সাহিত্য পরিবারের অনুষ্ঠান রৌমার, কুড়িগ্রাম -এর নবীন লেখিকা নিপা’র দুইটি কবিতা অর্ধ নারীশ্বর —– প্রীতম ভট্টাচার্য শেষ যাত্রা —- প্রীতম ভট্টাচার্য অর্পিতা সাহিত্য লাইব্রেরী-এ.এস.এল এর প্রাথমিকভাবে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন যাঁরা… ক্যান্সারে আক্রান্ত মাও. এনামুল হাসান ফারুকীর পাশে দাঁড়ালো আল ইরশাদ ফাউন্ডেশন –

বউয়ের চিঠি — মাসুদ রানা বনফুল 

  • প্রকাশের সময় : রবিবার, ৮ জুন, ২০২৫
  • ১৭০ বার প্রতিবেদনটি দেখা হয়েছে

আমাদের ছোট্ট গ্রামটা ছিল যেন ছবির মতো। গ্রামের চারপাশে শ্যামলিমায় ঘেরা, ধানখেত আর তালগাছের সারি, বাঁশঝাড়ের ছায়া, পাখিদের ডাক—সব মিলিয়ে একখানা স্বপ্নপুরী। গ্রামের নাম ছিল ‘চর নওয়াবপুর’। সেখানে সবাই একে অপরের আপন, সন্ধ্যার পর চায়ের দোকানে মিলতো ছোট-বড় সবাই। তবে ছবির মতো গ্রাম হলেও জীবিকার চিত্রটা ছিল অন্ধকার।

 

নুরুল হুদা সেই গ্রামেরই এক দরিদ্র কৃষক পরিবারের ছেলে। হালচাষ, ক্ষেতকাম, মাঝে মাঝে মাটি কাটা—যত কাজই করুক, সংসার যেন চালানোই দায়। তিন ভাইয়ের সংসারে ভাগ বসেছে জমির, কিন্তু পেটের ক্ষুধা ভাগ করা যায় না। এর মধ্যেই বিয়ে হয় রহিমা খাতুনের সঙ্গে। মায়াবতী, শান্ত স্বভাবের, সংসারের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রমী।

 

বিয়ের পর কিছুদিন ভালোই কেটেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে অভাব যেন ফণা তুলে উঠলো। বাজারের দামে চাল কেনা দুঃসাধ্য, ছেলের পড়ালেখা, শ্বশুর-শাশুড়ির ওষুধ, বাচ্চার দুধ—সব মিলিয়ে জীবনের ভার যেন অসহনীয়।

 

তখনই একদিন সিদ্ধান্ত নেয় নুরুল হুদা—বিদেশ যেতে হবে। সৌদি আরবে তার এক আত্মীয় কাজ করে, সেখান থেকেই সুযোগ মিললো। সমস্ত জমি বন্ধক রেখে, কিছু ধার করে আর গ্রামের মানুষদের কাছে হাত পেতে জোগাড় করলো খরচ। দুঃখী চোখে বিদায় নিলো রহিমা আর ছোট ছেলেকে রেখে।

 

প্রথমবার প্লেনে উঠা, অপরিচিত ভাষা, অপরিচিত দেশ, কিন্তু পেটের তাগিদে এসব ভুলে কাজ শুরু করলো। নির্মাণ শ্রমিকের কাজ। সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত একটানা খাটুনি। প্রচণ্ড গরমে মাথা ঘুরে যায়, তবু কাজ থেমে থাকে না।

 

প্রতি মাসে সামান্য কিছু টাকা পাঠাতো দেশে। প্রথমবার রহিমা টাকা পেয়ে চিঠি লিখেছিল—

 

প্রিয় হুদা,

তুমি কেমন আছো জানি না। তোমার চিঠি পড়ে চোখ ভিজে গেছে। তোমার পাঠানো টাকায় ছেলেটার বই কিনেছি। শাশুড়ির ওষুধ কিনেছি। আমি তোমার কষ্ট বুঝি। আল্লাহ তোমার সহায় হোন।

 

তোমাকে খুব মনে পড়ে। বৃষ্টির রাতে আমাদের সেই ছাউনি ঘরে একসাথে বসে চা খাওয়া, আমি আজও ভুলতে পারি না। ঈদ আসছে সামনে। এবারও তুমি থাকছো না। ঈদের সকালে আমার শাড়িটা পড়ে চোখ ভিজে যাবে, হুদা। ফিরে এসো, সময় পেলে।

 

— তোমার রহিমা

 

চিঠিটা পড়ে নুরুল হুদা চুপচাপ বসে ছিল সারারাত। চোখে পানি, কিন্তু কেউ দেখেনি। পরদিন আবার কাজে যায়, যেন কিছুই হয়নি। প্রতিবার ঈদের আগে রহিমার চিঠি আসে। তাতে থাকে ঈদের বাজারের কথা, ছেলের কোরআন পড়া শেখার কথা, শাশুড়ির অসুখ, আর থাকে একরাশ ভালোবাসা।

 

কিন্তু চিঠির শেষের কথাগুলো সবসময় এক—

“এবার ফিরে এসো হুদা। ছেলেটা অপেক্ষা করে। আমি ঈদের সকালে চোখে কাজল দেই না, তোমার জন্য।”

 

এই কথাগুলো তীরের মতো বিঁধে থাকে হুদার হৃদয়ে। কিন্তু সে ফিরতে পারে না। ঋণের টাকা এখনো পরিশোধ হয়নি। ছেলের ভবিষ্যৎ বানাতে হবে। সে ভাবে, আর এক বছর, এরপর ফিরে যাবে।

 

এর মধ্যেই কেটে যায় পাঁচটা বছর। চুলে পাক ধরেছে নুরুল হুদার, হাত শক্তিশালী হয়েছে কিন্তু মুখ শুকিয়ে গেছে। এই পাঁচ বছরে দেশে আর ফিরে যাওয়া হয়নি।

 

এক ঈদের আগে, ঠিক চাঁদরাতের দিন, তার রুমমেট এক চিঠি এনে দেয়। পরিচিত হাতের লেখা। খুলেই চোখ ভিজে ওঠে।

 

প্রিয় হুদা,

এবার ঈদের বাজার করিনি। ছেলেটা বড় হয়েছে, মাদ্রাসায় ভর্তি করেছি। নিজে নিজেই সে বলে—“আমার আব্বু আসবে ইনশাআল্লাহ, আমরা একসাথে ঈদের নামাজ পড়বো।” আমি শুধু হাসি, আর রান্নাঘরে গিয়ে কাঁদি।

 

তোমার পাঠানো টাকায় কিছুই কেনা হয় না এখন। বাজারের জিনিসপত্রের দাম কত বেড়েছে, তুমি জানো না। কিন্তু আমি জানি, তুমি নিজের খাওয়া কমিয়ে আমাদের টাকা পাঠাও।

 

তোমার শরীরটা ভালো তো? মাঝরাতে উঠি, ছাদে যাই, তারাদের দেখি—ভাবি, ঐ তারা কোথাও হয়তো তোমার মাথার ওপরও আছে।

 

তুমি কবে আসবে হুদা? শুধু একবার এসে গিয়ে আবার যেতে পারো। ঈদের সকালে শুধু তোমার মুখটা দেখতে ইচ্ছে করে। সেই চওড়া হাসিটা, যেটা আমি বিয়ের পর ভালোবেসে ফেলেছিলাম।

 

— তোমার রহিমা

 

নুরুল হুদা এবার আর নিজেকে থামাতে পারে না। ভোর রাতে বসেই সিদ্ধান্ত নেয়—এবার ফিরবে। কিছু না হোক, সন্তান আর স্ত্রীর মুখটা তো দেখবে। কাজ ছেড়ে দেয়, মালিকের সঙ্গে বিদায় করে। ভাঙা স্যুটকেসে পুরে কয়েকটা সস্তা জামা, আর বুকভরা আশা।

 

ফেরার পথে প্লেনের জানালা দিয়ে দেখে—মাটির বুকের মতো শান্ত আকাশ। যেন অনেক কিছু বলছে।

 

গ্রামে পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে যায়। গ্রামের মাঠে ছেলেরা খেলছে, পাখিরা ডাকছে, পুরনো চায়ের দোকান ঠিক আগের মতোই আছে।

বাড়ির সামনে এসে দেখে দরজা খোলা, উঠোনে ছেলেটা খেলছে। তাকে দেখে ছেলেটা কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে, তারপর দৌড়ে এসে বলে—

“তুমি আমার আব্বু না?”

 

নুরুল হুদা ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে, চোখে জল।

রহিমা দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়, মাথায় সাদা ওড়না, হাতে আলতা। বলে—

“এসেছো হুদা? এবার তো ঈদের সকালে কাজল দিতে পারবো চোখে?”

 

নুরুল হুদা শুধু মাথা নাড়ে। কণ্ঠে কোনো শব্দ আসে না। তার মনে হয়—পৃথিবীর সব কাজ, কষ্ট আর ত্যাগ এই একটুখানি মুহূর্তের জন্যই ছিল।

 

শেষ কথা:

এই গল্প শুধু নুরুল হুদার নয়, হাজারো প্রবাসীর। যারা আপনজন ছেড়ে, মাটি ছেড়ে, স্বপ্নের দেশে যায় শুধু পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে। কিন্তু সেই হাসিটুকু দেখতে পারা যেন সবচেয়ে বড় পুরস্কার।

রহিমার চিঠির মতো প্রতিটি পরিবারের মনেও থাকে একটাই কথা—

“ফিরে এসো, শুধু একবার, ঈদের সকালে আমাদের সঙ্গে থাকো।”

Facebook Comments Box
এই ক্যাটাগরির আরও খবর
© স্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ ইচ্ছাশক্তি
Theme Customized By Shakil IT Park