ফিরে এসো আদ্রিতা
জাকির আলম
দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখি রাত তখন ১২টা বেজে ৩৯ মিনিট। কিছুতেই আজ চোখে ঘুম আসছে না। প্রচণ্ড নিঃসঙ্গতা অনুভব করছি। চারদিকে থমথমে নীরব পরিবেশ। মনে হচ্ছে আমিই শুধু জেগে আছি একলা ঘরে শূন্য বিছানায়। নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে উঠতে একের পর এক ধূমপান করে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে সিগারেটের ধোঁয়ার সমুদ্রে আমি ডুবে আছি। এভাবে ধূমপান করতে করতে ভীষণ ভাবে ধীরে ধীরে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। এমতাবস্থায় আদ্রিতাকে ফোন দিয়ে দেখি ওর ফোন বন্ধ। কয়েক বার চেষ্টার পর ব্যর্থ হয়ে গেলাম আদ্রিতার সাথে কথা বলতে। খুব মিস করছি আদ্রিতাকে। আদ্রিতার চলে যাওয়ার সপ্তম দিনে ওর কথা ভীষণ মনে পড়ছে। ওর মায়াবী মুখখানি এক নজর দেখার জন্য মনটা ছটফট করছে। খুব কষ্ট হচ্ছে আজ ওকে ছাড়া একা থাকতে। এর আগে কখনো ওর কথা ভেবে এতোটা কষ্ট হয়নি আমার। আদ্রিতা আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষ। পাঁচ বছর চুটিয়ে প্রেম করার পর আমরা লাভ ম্যারেজ করেছিলাম নিজেদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক। আদ্রিতা ছিলো ওর বাবা-মায়ের একমাত্র আদরের মেয়ে। ওর বাবা শহরের বড় ব্যবসায়ী। ফলে আদ্রিতাদের টাকা-পয়সার কোনো অভাব ছিলো না। সোনার চামচ মুখে নিয়ে আদ্রিতার জন্ম হয়েছিলো।
ছাত্রী হিসেবেও খুব মেধাবী ছিলো। জীবনে কোনোদিন ক্লাসে দ্বিতীয় হয়নি সে। সবসময় ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাস করেছে প্রতিটি পরীক্ষায়। ওর মনটাও ভীষণ রকম ভালো। আভিজাত্যের কোনো দম্ভ বা অহংকার নেই ওর মনে। আমার জীবনে এতো ভালো মনের মানুষ খুব কম দেখেছি। শুরুতে আমাদের মাঝে ভালো বন্ধুত্ব ছিলো। এক সাথে থাকতে থাকতে ক্রমশ আমরা একে অন্যের প্রতি প্রবল ভাবে দুর্বল হতে থাকি। কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারিনা। একদিন দেখা না হলে যেন পাগল হয়ে যেতাম আমরা। আদ্রিতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থেকে পড়ালেখা করতো। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই এক বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতাম। ক্লাস শেষ হতেই ক্যাম্পাসের উত্তর পাশে গাছের নিচে পুকুরপাড়ে যে বসার যায়গাটা ছিলো সেখানেই আমরা প্রতিদিন পাশাপাশি বসে জীবনের সবচেয়ে ভালো সময় কাটিয়েছি। বাদাম আর ফুচকা ছিলো আদ্রিতার প্রিয় খাবার। প্রতিদিন সেগুলো তাকে খাওয়াতে হতো।আদ্রিতা আমার কাছে কখনো দামি কোনো উপহার সামগ্রী পাওয়ার প্রত্যাশা করতো না। ও জানতো আমি মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির সন্তান। তবুও আমি নিজ থেকে চেষ্টা করতাম ওকে কিছু না কিছু উপহার দিতে। প্রতি বছর ফাগুনের প্রথম দিন ওকে একটা করে বাসন্তী রঙের শাড়ি উপহার দিতাম।
এতেই ও ভীষণ খুশি হতো। শাড়িতে ওকে ভীষণ সুন্দর লাগে। বেশি সুন্দর লাগে যখন শাড়ি পরে চুলের খোঁপায় গোলাপ ফুল গুঁজে সুন্দর করে সাজগোছ করে। আদ্রিতাও আমাকে মাঝেমাঝে কিছু না কিছু উপহার দিতো। ওর সব উপহার আমি খুব যতন করে রেখে দিয়েছি আমার নিজস্ব আর্কাইভে। বন্ধুত্বের জায়গা থেকে সরে এসে যখন আমরা ক্রমশ একে অন্যের প্রতি প্রবল ভাবে দুর্বল হতে থাকি, তখন হঠাৎ করে একদিন বড় লোকের এক ছেলের সাথে আদ্রিতার বিয়ের সম্বন্ধ আসে। আদ্রিতা পরীর মতো সুন্দর ছিলো বিধায় প্রথম দেখাতেই তাকে দেখতে আসা সেই ছেলে এবং তার ফ্যামিলি আদ্রিতাকে পছন্দ করে ফেলে। ওর বাবা-মাও রাজি হয়ে যায় সেখানে বিয়ে দিতে। আমি এসবের কিছুই জানতাম না। পরের দিন যখন ক্যাম্পাসে যাই তখন আদ্রিতার মুখে সেসব কথা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ভীষণ রকম টেনশনে পড়ে যাই আমরা। একে অন্যকে ছাড়া থাকতে পারবো না তাই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু ওই অবস্থায় আমরা কি করবো বা কিভাবে বিয়ে করবো তা মাথায় আসছিলো না। আদ্রিতার ফ্যামিলি কিছুতেই আমার সাথে বিয়ে দিতে রাজি হবে না। এদিকে আমি আদ্রিতাকে হারানোর ভয়ে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছি। আদ্রিতাও আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবে না। তাই শেষ পর্যন্ত আমরা কাজী অফিসে গিয়ে লাভ ম্যারেজ করতে বাধ্য হই। এটা ছাড়া আমাদের আর করার কিছু ছিলো না।
ক্লাসের কয়েক জন ক্লোজ বন্ধুকে সাক্ষী হিসেবে সাথে করে নিয়ে কাজী অফিসে গিয়ে আমরা পবিত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। তারপর শুরু হয় আমাদের একসাথে থাকা। খুব সুখেই আমাদের সংসার চলতে থাকে। ততোদিনে আমি শহরের এক প্রাইভেট সেক্টরে ভালো বেতনের এক জব নিয়েছি। আদ্রিতা তখনো কিছু করতো না। বাসায় থেকে চাকরির প্রস্তুতি নিতে থাকে। আদ্রিতা উচ্চ বিত্তের মানুষ হলেও স্বভাবে একদম সাদা মাটা গোছের। বিলাস বহুল জীবন ওর একদম পছন্দ নয়। বিয়ের পর অবসর সময়ে মাঝেমাঝে আমরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেতাম। আদ্রিতার প্রিয় জায়গাগুলো ঘুরে দেখানো এবং তার প্রিয় খাবারগুলো আমাকে খাওয়াতে হতো। অবসর সময়ে আদ্রিতা কবিতা এবং গল্পের বই পড়তে অনেক পছন্দ করতো। তাই বিভিন্ন সময় ওকে ওর প্রিয় লেখকের কবিতা এবং গল্পের বই উপহার দিতাম। কবিতা বা সাহিত্য বিষয়ে কোনো বই পড়তে আমার তেমন ভালো লাগে না। তবুও আদ্রিতার ভালো লাগাকে প্রাধান্য দিয়ে ওর ভালো লাগার জায়গাটাকে সম্মানের সহিত অনুমোদন করতাম। নিত্য নতুন পোশাক পরিধানে আদ্রিতার তেমন কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। খুব সাধারণ ভাবে বসবাস করতেই ও বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করতো। এভাবে আমাদের বিয়ের প্রায় এক বছর হতে চলে।
আমি প্রচণ্ড ভাবে ধূমপান করতাম আগে থেকেই। যেটা আদ্রিতা একদম পছন্দ করতো না। বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও আদ্রিতার এই কথাটা আমি রাখতে পারিনি। তারপর আমাদের ছোট ছোট বিষয় নিয়ে ঝগড়া হতে থাকে। ধীরে ধীরে আমাদের বৈবাহিক সুসম্পর্ক ভিন্ন আবহে রূপ নেয়।একটা কথা না বললেই নয় ; আদ্রিতার ভীষণ রাগ ছিলো। একবার রেগে গেলে আমার খবর আছে। একদম বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে আমার। এই একটা জায়গায় ও অবিচল। কিছুতেই আপস করতে রাজি নয়। তবে এমনিতে ও ভীষণ ভালো একটা মেয়ে। বিয়ের পর খুব কেয়ার করতো আমার। আমার সব ভালো লাগাকে প্রাধান্য দিতো। কিসে আমি হাসি-খুশি থাকি সেটা সে ভালো করেই রপ্ত করেছিলো। তাই তন্ত্রে-মন্ত্রে আমি বলবো- আদ্রিতা ভীষণ একটা লক্ষ্মী মেয়ে। আদ্রিতার কোনো বাজে অভ্যাস নেই। কিন্তু একটা সময় পর আমাদের তেমন বনিবনা হচ্ছিল না। কেউ কাউকে মানিয়ে নিতে পারছি না। সারাক্ষণ শুধু ঝগড়া লেগে অভিমান করে থাকতে হতো আমাদের। কেউ কাউকে সরি বলে সমস্যা সমাধানের পথ না খুঁজে দিনের পর দিন এভাবে চলতে থাকে। ধীরে ধীরে আমাদের মাঝে একে অন্যের প্রতি অবহেলা বাসা বাঁধতে থাকে। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছি না।
রাত এলে তখন দু’জন আলাদা বিছানায় ঘুমাতে হতো। কেউ কারো মুখ পর্যন্ত দেখা হতো না। এভাবে চলতে থাকে দিনের পর দিন। ফলে ক্রমশ যেন আমরা দূরে চলে যাচ্ছি আমাদের চেনা ভুবন থেকে। একটা পর্যায়ে এভাবে আর একসাথে থাকা সম্ভবপর হয়ে উঠে না। তাই যৌথ সিদ্ধান্ত নিলাম এভাবে আর না থেকে আমরা আলাদা হয়ে যাই। আমরা মুক্ত হয়ে যাই। ওই অবস্থায় নিঃশ্বাস নিতেও যেন আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। তাই শেষ পর্যন্ত আলাদা থাকার জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলাম। সিদ্ধান্ত মোতাবেক আদ্রিতা একাই ওদের বাসায় চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করলো। ওর সবকিছু গোছাচ্ছে একাই। শেষবারের মতো আদ্রিতাকে হারানোর কষ্ট সইতে পারছি না। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ একজন মানুষকেও ধরে রাখতে পারলাম না। আমার প্রিয়তমা স্ত্রী আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছে। অথচ আমি কিছুই করতে পারছি না। না পারছি ধরে রাখতে, না পারছি কষ্ট সহ্য করতে। এক প্রকার চাপা কষ্টে বুকটা যেন আমার ফেটে যাচ্ছে। চোখ দিয়ে অবিরত পানি পড়ছে। এদিকে আদ্রিতা সবকিছু গুছিয়ে আমাকে ফেলে দূরে চলে যাচ্ছে। আদ্রিতার মুখেও এক প্রকার কষ্টের ছাপ লক্ষ্য করেছিলাম। চলে যাওয়ার সময় আমার দিকে দ্বিতীয় বার ফিরেও তাকায়নি। শুধু বলে গেলো ‘আমি চলে গেলাম তোমাকে মুক্ত করে দিয়ে। তুমি ভালো থেকো আবির’। এই একটি কথায় আমার সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে গেলো।
চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে হলো। অথচ তা করতে পারছি না। চাপা কান্নায় বুকটা আমার পাথর হয়ে গেলো। বারবার চোখের জল মুছতে ছিলাম। আদ্রিতার চোখেও জল ছিলো। কিন্তু থেকে যাওয়ার জন্য শেষ বারের মতো কোনো আক্ষেপ ছিলো না। আদ্রিতা চলেই গেলো আমার জীবন থেকে। আর কোনোদিন আদ্রিতাকে দেখতে পারবো না এটা মনে হতেই হৃদয় পাঁজর যেন কাচের মতো ভেঙে খানখান হতে থাকে। আমি আর একা থাকতে পারছি না। কখনোই বুঝতে পারিনি আদ্রিতা চলে গেলে আমার এতো কষ্ট হবে ! যে মানুষটা আমাকে এতো বেশি কেয়ার করতো, সকালে অফিস যাওয়ার পথে আমাকে সাহায্য করা। এই যেমন শার্টের বোতাম লাগিয়ে গলায় টাই বেঁধে দেওয়া, মাথার চুল আঁচড়ে দেওয়া, চোখে চশমা পরিয়ে দেওয়া,পায়ের জুতো পরিস্কার করে দেওয়া, মানি ব্যাগ এবং রুমাল গুছিয়ে দেওয়া, বুকে জড়িয়ে ধরে গালে এবং কপালে চুম এঁকে দিয়ে হাসি মুখে বিদায় দেওয়া,এসব কথা মনে হতেই বুকের ধমনি যেন ফেটে যাচ্ছে । কিছুতেই আদ্রিতার চলে যাওয়াটা সহ্য করতে পারছি না। কি করে আদ্রিতাকে ফেরাবো সে কথা আমার মাথায় কিছুতেই আসছে না। এমতাবস্থায় আদ্রিতা সত্যিই আমাকে একা ফেলে চলে গেলো তার নিজস্ব গন্তব্যে। বারংবার ফেরাতে চেয়েও ব্যর্থ হয়ে গেলাম আমি। চলে যাওয়ার পথে আদ্রিতা বারবার বাসার দিকে ফিরে তাকাচ্ছিলো। দু’চোখ থেকে অশ্রু ঝরছিলো। হয়তো আমার মতো আদ্রিতাও চলে যেতে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিলো। প্রচণ্ড এক অভিমানে চলে গেলো আদ্রিতা।
আদ্রিতার চলে যাওয়ার সপ্তম দিন আজ। গভীর নিঃসঙ্গতা বোধ করছি। কিছুতেই চোখে ঘুম আসছে না। শ্রাবণের বারিধারার মতো অবিরত চোখ থেকে জল ঝরছে। কারো কাছে তা বলে-কয়ে নিজেকে হালকা করতে পারছি না। কষ্ট সহ্য করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার। তাই এক পর্যায়ে মনের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আদ্রিতার ফোনে কল দিতে গেলে কথা বলতে ব্যর্থ হয়ে যাই। কারণ আদ্রিতার ফোন বন্ধ ছিলো।
এদিকে আদ্রিতার বাসায় গিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসার সাহস বা মুখ কোনোটাই নেই আমার। কিভাবে যাবো তার বাসায়। বাসায় গিয়ে কিবা বলবো তাকে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে আমি যেন বিরহে মরে যেতে যাচ্ছি। আদ্রিতাকে ছাড়া আমি বড় একা। ওর শূন্যতা আমি কিছুতেই পূর্ণ করতে পারছি না। ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছি। নিজেকে চিনতেও আজ বড্ড কষ্ট হচ্ছে আমার। প্রচণ্ড কষ্টে আমার সময় অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে। অথচ আমার পৃথিবী যেন থেমে গেছে এক আদ্রিতাকে ছাড়া। ধীরে ধীরে আমি যেন ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছি। বেঁচে থাকার সব নিশ্চয়তা যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শেষবারের মতো আদ্রিতাকে কাছে পেতে মরিয়া হয়ে উঠছি। এক নজর দেখার জন্য আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। আদ্রিতা আমার প্রিয় আদ্রিতা। তোমাকে ছাড়া আমি বড় একা। তুমিহীন মরে যাওয়াও ভীষণ কষ্টের।
তুমি ফিরে এসো আদ্রিতা,ভুলে যাও যতো অভিমান
তুমিহীন এই জগৎ সংসারে আমি ভীষণ ম্রিয়মান।
তোমার দ্বিধায় বাঁচি আমি,তোমাতে হতে চাই অবসান
তোমার পৃথিবীর সুখের লহরী আমার পৃথিবীতে বহমান।
তুমি ফিরে এসো আদ্রিতা, তুমি ফিরে এসো,
মনের টানে, ভালোবাসার নিকেতনে।
তুমি ফিরে এসো, তুমি ফিরে এসো…