পরিশ্রমের পথিকৃৎ
ইয়াকুব আলী তুহিন
একটি ছোট্ট গ্রামে রাকিব নামে একজন কৃষক বসবাস করত। তার বয়স ছিল ৩৫ বছর, এবং সে খুবই সৎ ও পরিশ্রমী মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিল। তার পরিবারে স্ত্রী এবং দুই সন্তান ছিল। রাকিবের স্বপ্ন ছিল তার সন্তানদের শিক্ষিত করে বড় করা এবং তাদের একটি ভালো ভবিষ্যৎ দেওয়া। কিন্তু সে যেভাবে চেয়েছিল, সেভাবে সবকিছু ঘটছিল না। রাকিবের জমি খুবই উর্বর ছিল না, তাই ফসলের ফলনও কম হতো। যা কিছু ফলত, তা দিয়ে সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে যেত। প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে কাজ করেও সংসারের চাহিদা মেটাতে তার খুব কষ্ট হতো। তবু সে কখনো হাল ছাড়েনি।
একদিন গ্রামে একটি বড় বন্যা হলো। রাকিবের জমির সব ফসল পানিতে ডুবে গেল। তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। সে জানত না কিভাবে সে তার পরিবারকে এবার বাঁচাবে। অন্যদিকে, গ্রামের আরও অনেক কৃষকও একই অবস্থায় ছিল। সবাই হতাশ হয়ে পড়েছিল। রাকিব ঠিক করল যে সে শহরে গিয়ে কোনো কাজ খুঁজবে। সে তার পরিবারের জন্য কিছু করতে চায়, যেভাবেই হোক। শহরে এসে সে দিনমজুরের কাজ শুরু করল, কিন্তু তার গ্রামের জীবন শহরের কঠিন বাস্তবতার সামনে খুবই ক্ষুদ্র বলে মনে হচ্ছিল। শহরে কাজ করতে গিয়ে সে প্রতিদিন দেখত কত মানুষ কষ্ট করে জীবনযাপন করছে, কিন্তু তার মধ্যেও কেউ কেউ সাফল্যের মুখ দেখছে।
একদিন রাকিব এক বৃদ্ধ মানুষকে দেখল, যিনি রাস্তায় পিঠা বিক্রি করছিলেন। বৃদ্ধের বয়স হয়েছিল প্রায় ৬৫, কিন্তু তার মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি ছিল। রাকিব জানতে চাইল, “আপনি এ বয়সে এভাবে কাজ করছেন? আপনি কি ক্লান্ত হন না?”
বৃদ্ধ হেসে বললেন, “ছেলে, জীবন কখনো থামে না। আমি জীবনের অনেক কিছু হারিয়েছি, কিন্তু হাল ছাড়িনি। তুমি যদি সত্যিকার অর্থে কিছু করতে চাও, তবে পরিশ্রমের বিকল্প নেই। আরেকটি বিষয়, নতুন কিছু শিখতে ভয় পেও না। আমি ৫০ বছর বয়সে পিঠা বানানো শিখেছি, আর এখন এটাই আমার জীবিকা।”
বৃদ্ধের কথাগুলো রাকিবের মনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলল। সে ভাবল, কেন সে শুধু কৃষিকাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে? নতুন কিছু শিখে যদি নিজের জীবন বদলানো যায়, তাহলে চেষ্টা করতে হবে। রাকিব বাড়ি ফিরে এল এবং ঠিক করল যে সে আর শুধু ফসলের ওপর নির্ভর করবে না। সে গ্রামে ছোটখাটো ব্যবসা করার পরিকল্পনা করল। কয়েক মাস পর, রাকিব একটি ক্ষুদ্র খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবসা শুরু করল। সে নিজে তার জমিতে ফলানো ফসল থেকে আচার, মসলা, এবং অন্যান্য পণ্য তৈরি করে বাজারে বিক্রি করতে শুরু করল। তার পণ্যগুলো একসময় আশেপাশের বাজারগুলোতেও জনপ্রিয় হয়ে উঠল। রাকিব ধীরে ধীরে তার ব্যবসা বড় করতে লাগল এবং গ্রামের অন্য কৃষকদেরও উৎসাহিত করল যেন তারা নিজেদের ফসল থেকে ভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি করে বাজারজাত করতে পারে।
এইভাবে রাকিব শুধু নিজের জীবনের পরিবর্তন আনল না, সে তার গ্রামের মানুষের জীবনেও নতুন আশার আলো ছড়িয়ে দিল। কিছু বছর পর, রাকিবের দুই সন্তানও উচ্চশিক্ষা লাভ করল, এবং তারা বাবার ব্যবসায় যোগ দিয়ে সেই ব্যবসাকে আরও বড় করে তুলল। এই গল্প থেকে আমরা শিখতে পারি, প্রতিকূলতা আসবেই, কিন্তু তার মানে এই নয় যে জীবন থেমে যাবে। জীবনে নতুন কিছু শিখতে এবং নিজেকে পরিবর্তন করতে হলে সাহসী হতে হয়। জীবন সবসময় নতুন সুযোগের হাতছানি দেয়, প্রয়োজন শুধু সেই সুযোগগুলোকে কাজে লাগানোর।