আট ভাই বোনের সবচেয়ে ছোট বোনটি হলো রুমা। পিতামাতার সবচেয়ে আদরের মেয়ে এই রুমা । ছোট ভাইয়ের ছিলো নয়নের মনি। ভালোবাসার কোনো কমতি ছিলোনা আট ভাই বোনের সংসারে। কিন্তু দারিদ্রতা ও ছিল তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। কিছুতেই যেন এই দারিদ্রতা তাদের পিছু ছাড়ছে না। আসলে দারিদ্রতা তাদের অতীতে ছিল না, নিজ চাচার প্রতারণার শিকার হয়ে জমিজমা সব হারিয়ে তারা হয়েছেন পথের ফকির। এই অভাবের সংসারে জন্ম নেন রুমা। সেই কষ্টের কথা স্মরণ করে রুমা বলেন বাবা আমায় আদর করে ডাকতেন জেসমিন। মা ও আমায় আদর করতেন কিন্তু সব চেয়ে বেশি আদর করতেন ছোট ভাই। আমার জন্মের আগে বিয়ে হয়ে গেছে বড় তিন বোনের বাকি ছিলাম আমি আর সেজো আপা। জন্মের পর থেকেই অভাব কে দেখেছি কিন্তু মা প্রায় বলতো বড় হলে দেখিস পরের বাড়ি গেলে অনেক ভালো থাকবিরে মা, মিলিয়ে নিস মায়ের কথা। কথা শুনে হাসতাম আমি আর আপা কিছু বুঝতাম না। খাবার সময় কোনো দিন তিন বেলা পেট ভরে ভাত খেয়ে দেখিনি আমারা। এমন করে পার করি শৈশব কিন্তু কৈশোরে পা রাখলেই জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয় ,দশ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে ফেলি। আমি এতিম হয়ে যাই। বড় ভাই বিয়ে করে বাবা থাকতেই আলাদা হয়ে গেছে কোনো খোজ খবর নিতেন না ,বাবা মারা যাওয়ার পর সম্পর্কে মাঝে ধরলো বিশাল ফাটল।সব মিলিয়ে তারপর ও বলতাম আলহুন্দুলিল্লাহ ভালো আছি কিন্তু সত্যি বলতে আমরা ভালো ছিলাম না। পেটে ছিলো ক্ষুদা মনে ছিলনা শান্তি পরনে ছিলনা ভালো কোনো পোশাক। তবুও করো প্রতি ছিলোনা কোনো অভিযোগ কারণ আমি মেনে নিয়েছিলাম এটা আমার নিয়তি। বড় হতে থাকলাম ছোট ভাইয়ের বউ এর অবহেলায়।
খোটা লাঞ্ছনা বঞ্চনা আর কত নিয়তির খেলা আমার জীবনে। বলতে বলতে উপযুক্ত হলাম বিবাহের কিন্তু গায়ের রং তুলনামূলক কালো হওয়ায় আর চড়া যৌতুক বিয়েতে চরম বাঁধা। কিন্তু নিয়তি যে তার নিজ ধারায় চলে তাকে কি আর বেঁধে রাখা যায়। চেয়েছিলাম নিয়তিকে বেঁধে রাখতে কিন্তু পারলাম কই ! নিয়তি সব বাধা পেরিয়ে ছুটে চলতে শুরু করে কিন্তু থামে না আমি ও বিধাতার কাছে বলে দিয়েছি এর শেষ কোথায় গিয়ে থামে আমি দেখবো। সকল বিপদ বাঁধার বিধাতার উপর ছিল আমার চরম বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস আমাকে অনেক সাহায্য যোগাড় করে দিতো। আমার মা ও ছিলো অনেক ধার্মিক বলতে গেলে আমি একটা ধার্মিক পরিবারের সন্তান কিন্তু ইসলামিক বিধান আমার মায়ের পর আমাদের বোনেদের উপর দেখা যায় তাও কম আর কারো মধ্যে তেমন ধার্মিকতা নেই বললেই চলে। ধর্মের চর্চা তেমন করেন না তেমন কেউ । যাই হোক ২০০০ সালের কথা বলি তখন নব বধূ রূপে সাজি আমি,এক জন শিক্ষিত সুদর্শন পুরুষএর সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে তবে শুনছি শশুরি মা নাকি অনেক রাগী মানুষ। পাশের বাড়ির খালা বলেন কিরে জেসমিন হুনলাম তোর হাওরী নাকি অনেক রাগী ঝগড়া করে। চুপ করে রইলাম ! নীরব মনে মনে বির বির করে বললাম শান্তি বোধহয় এই অভাগীর কপালে নাই। যাইহোক বিয়ের পর গেলাম শশুর বাড়ী প্রথমে দেখলাম সবই ভালো কিন্তু বাসর রাতে স্বামীর ব্যবহার ভালো লাগে নাই,কি করবো? ভালো না লাগলেও সে আমার স্বামী ,না লাগলেও সে আমার স্বামী ।মেনে নিলাম সব কিন্তু দিন যেতে যেতে দেখি আমার ননদ গুলো তেমন ভালো না তাদের কাজকাম ভালো না।
আমার বড় ননদ আমার স্বামীর ছোট আর কি! ওর বিয়ে হয় আমার আগে কিন্তু থাকতো বাপের বাড়ী। বাপের বাড়ি থেকে যত রকম কুটনামি করা যায় তাই করতো। শশুর বাড়ির আর্থিক অবস্থাও সেই বাপের বাড়ির মতোই অসচ্ছল বলাই চলে। ভাত দিতো মেপে মেপে চাইলেও পেট পুড়ে ভাত খেতে পারি নাই। বিয়ের প্রায় দের বছর পরে আমি অন্তঃসত্ত্বা হই। এই সময়ে সবাই একটু বাহিরের জিনিস খায় কিন্তু আমার মত গৃহস্থ বাড়ির বৌদের কপালে তা আর জুটলো কই। মিথ্যা বলবো না স্বামী আমার অনেক সময় আচার চকলেট আনতো খেতাম মন ভরে।কিন্তু এত সুখ আমার হজম হইলো না শুরু হইলো আমার শরীর খারাপ মরার মত অবস্থা ,চলে আসলাম বাবার বাড়ি অসুস্থতা হলো দ্বিগুণ শুনলাম করা হয়েছে আমাকে কালো জাদু এটা শুনার পর আমার মা আমাকে একটা তদবির এনে দেয়। তিন মাস শুয়ে ছিলাম জ্বর আর জন্য । সুস্থ হলাম তদবির নিয়ে অর্থাৎ তাবিজ কবজ নিয়ে এর পর গেলাম ডাক্তারের কাছে ডাক্তার বললো হয় মা বাঁচবে নতুবা সন্তান চিন্তা করুন মনে রাখবেন উভয় কিন্তু এক সাথে বাঁচবে না।
কি করবো সবাই আর ওনার কথা অনুযায়ী সহমত পোষণ করলাম কিন্তু বাচ্চা নষ্ট করিনি আমার প্রথম সন্তান হলো ৭ মাসে কিন্তু মরা যা মা হিসেবে মেনে নেওয়া কঠিন কিন্তু মেনে নিলাম সবই উপর ওলার খেলা। এর পর সব ঠিক থাক চলতে শুরু করলো আমি বাবার বাড়ি থাকি আর উনি থাকেন ওনার বাড়ি এমন করে দেখা যেত অনেক সময় উনি আসতো আমাদের বাড়ি ।এক সময় উনি নিয়ে যায় শশুর বাড়ি আমাকে অনেক নির্যাতন সহ্য করে দাঁত কামড়ে পরে ছিলাম ঐখানে এক সময় আবার ও জানতে পারি আমি মা হবো এই বার আর শশুর বাড়ি নয় চলে আসলাম বাপের বাড়ি বাচ্চা হওয়ার ৯ মাস বাপের বাড়ি ছিলাম সেখানেও ছোট ভাইয়ের বৌয়ের নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে আমাকে তবুও সব সহ্য করে জন্ম দিলাম দ্বিতীয় সন্তান উনি আদর করে নাম রাখলেন সুমন আর আমার মা নাম রাখলেন নূরনবী। এরপর সন্তান লালন পালন নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম তাও অন্যের বাড়িতে না বাপের বাড়ি না শশুর বাড়ি, ছিলাম গ্রামে ভাড়া বাড়ি।
ছেলে বড় হচ্ছে কিন্তু অভাব যাচ্ছে না তবুও স্বামীর ভালোবাসায় কমতি ছিলো না কিন্তু মাঝে মাঝে ঝগড়া হলে অনেক মারতো। যাই হোক গরীব সকল পরিবারে এই সমস্যা আছে। আমার সব চেয়ে আফসোস লাগে আমি নিয়তির কাছে আমি বার বার পরাজিত হচ্ছি। নিয়তি খেলছে আমার সাথে খেলছে শুধুই খেলছে! সব মানিয়ে নিয়ে আমি এখন পাকাপোক্ত একজন নিয়তির হাতের পুতুল। যা বলতে চেয়েছিলাম এক ছেলে বড় করতে গিয়ে জানতে পারলাম আরও একজন সন্তান আসছে ! আনন্দে আত্মহারা আমি কিন্তু আমার স্বামী একটু মন খারাপ করলো মেনে নিতে পারেন না উনি বলেন এই অভাবের মধ্যে এক সন্তান নিয়েই হিমসিম খাচ্ছি আরও একজন আসলে তাকে কি করে লালন পালন করবো! কথায় কথায় ছোট ছেলে পৃথিবীর আলো দেখলো, তাকে সবাই ভালোবাসতো। কিন্তু এই ছোট ছেলেকে নিয়ে আমাদের ভাগ্যর চাকা পরিবর্তন করতে চলে আসি ঢাকায়। কে জানতো? ঢাকায় এসে ভাগ্যর চাকা পরিবর্তনের সাথে সাথে জীবনের মোর ঘুরে গেলো আমাদের।
কিন্তু এখানে আমাদের বলতে একটা মানুষ চিরতরে হারিয়ে গেলো আমাদের থেকে। সে হলো আমার পথ চলার পরাজিত বন্ধু। এর ৬ মাস পর মারা গেলেন আমার ছোট ভাই তার ৬ মাস পর মা। এখন আমার আপন বলতে তেমন কেউ নাই শুধু দুই ছেলে ছাড়া। প্রতিজ্ঞা করলাম দুই সন্তান মানুষ করবো মানুষের মতো করে। কিন্তু রাজধানীর পথ চলা সহজ কথা নয় কাউকে চিনিনা না জানিনা কোথায় থাকবো ।আমার শাশুড়ি ঢাকায় একটা বস্তিতে আমারে রুম ভাড়া করে দিলেন ১৫০ টাকায় কিন্তু এ ভাড়া আমি দিবো কিভাবে আমার তো কোনো আয় রোজগার নাই। পড়ে আমার এক প্রতিবেশী খালা আমারে গার্মেন্টস কর্মী হিসেবে একটা কাজ দেন। এই সময়ে আমার বড় ছেলের বয়স ২.৫ বছর ছোট ছেলের বয়স ১বছর ।এই অবস্থায় কার কাছে রেখে যাবো এদের কিন্তু তাদের রেখে গেলাম বিধাতার উপর বিশ্বাস করে তিনি দেখবেন আমার সন্তানদের। আর তিনি আমার সহায় হয়েছেন আমার সমগ্র বিপদে। এক সময় শশুর শাশুড়ি মারা যান। একটা আপন বাসুর ছিলো, কিন্তু কখনো আমাদের কোনো আর্থিক বা সামাজিক সহযোগিতা তিনি করেন নি তার কথা কি বলবো,আমার বাবার বাড়ির মানুষ ও কখনো আমাকে কোনো সাহায্য করে নি নেয় নি কোনো খোঁজ। কিন্তু আজ আমি একজন গর্বিত মা কারণ দুঃখের সাগর পাড়ি দিয়ে দুই সন্তান নিয়ে এখনো লড়াই করে যাচ্ছি ।লড়াই যেনো শেষ হচ্ছে না আমার। বড় ছেলে সঙ্গীত অঙ্গনে কাজ করছে কিন্তু ইসলাম বাদ্যযন্ত্র হারাম বলায় ইসলামিক সঙ্গীত করছে।
পাশাপাশি চিত্রঙ্গন,বক্তৃতা,আবৃত্তি ও করে,ভালো কবিতা ও লেখে কবিতার জন্য মনোনয়ন পেয়েছিল মহাত্মা গান্ধী শান্তি পুরষ্কার। ছোট ছেলেটাও ভালো তবে দুষ্ট বেশি এক কথায় দুষ্ট এর শিরোমণি লংকার রাজা বলা যায়। সে এখন অটো মোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং করছে। সব মিলিয়ে ভালোই চলছে আমার পরিবার।কিন্তু মজার বিষয় হলো এতো বড় বিপদজনক রাস্তা আমাকে একাই পার করতে হয়েছে এখনো করছি। আসলে জীবনটা অনেক ছোট তার পরিধি কিন্তু বড় এই ছোট জীবনে কত কিছু ঘটে যায় কেউ টের পর্যন্ত পায় না। তাই এ জীবনে প্রতিটা সিদ্বান্ত নিতে হয় হাজার দিক বিবেচনা করে । আজ আমি অনেক ভাত রান্না করি খেতে ইচ্ছে হয় না কিন্তু একসময় ভাত পেতাম না পেট ভরে খাওয়ার জন্য। আমি নারী আমি পারি বলবো না ,বলবো আমি পেরেছি নারী হয়ে ও পুরষের ন্যায় সংগ্রাম করতে। পরিশেষে বলবো নিয়তি শিক্ষা দেয় আর আমরা বোকারা বুজতেই পারি না আর বোধহয় পারবো না। তাই বলবো আমি বিশ্বাস রেখেছিলাম বুকের ভেতর সাহস ছিল আমার অনুভবে,আমি জানতাম জীবন একটা সংগ্রাম আর প্রকৃত বিজয় মানেই একটা প্রত্যাশিত আসল সুখ।
Website: www.ichchashakti.com E-mail: ichchashaktipublication@gmail.com