কথিত আছে সময় ও শ্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। মানব জীবনে সময়ের গুরুত্ব অপরিসীম। সময়ের প্রতিটি মহূর্তেকে যথাযথ কাজে লাগাতে না পারলে ব্যক্তিজীবন, সমাজ জীবন এমনকি রাস্ট্রীয় জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয় নিঃসন্দেহে। সময়ের মূল্য না বুঝলে উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব নয়। বহুল প্রচলিত একটি কথা: সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়।
তাই পার্থিব জীবনের এক মহূর্ত সময়কেও অবলীলায় নষ্ট করা যাবে না। সময় তার আপন গতিতে ছুটে চলেছে অবিরত, কেউ চাইলেও সময়ের গতি রোধ করতে পারবে না। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলছে বিশ্বময় উন্নয়নের গতিধারা। যে জাতি সময়ের মূল্য বুঝে যথাযথ কাজে লাগাচ্ছে, সে জাতি তত উন্নয়নের শীর্ষে উত্তীর্ণ হচ্ছে। সকল উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি তথ্যপ্রযুক্তি। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটে চলেছে নিরন্তর। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে মুহূর্তের মধ্যে বিশ্বের যেকোন প্রান্তে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র সবাই উপকৃত হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে চাঁদের দেশেও পাড়ি জমাচ্ছে মানুষ। আবার এই তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রযুক্তির হাজারো অবদানের মধ্যে মোবাইল গেম একটি । মোবাইল গেম বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে তরুণ সমাজ মোবাইল গেমের প্রতি এতটাই আসক্ত যে, তারা দৈনিক আট-দশ ঘণ্টারও বেশি সময় মোবাইল গেমে অপচয় করছে। যা তরণ সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্য অশনিসংকেত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৮ সালে মোবাইল গেম আসক্তিকে ‘রোগ’ বলে আখ্যায়িত করেছে।
জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান অর্থাৎ সোনালি সময় হলো তরুণ বয়স। কারণ তরুণ বয়সে মানুষ তার জীবনের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে। পড়ালেখা এমনকি শ্রমশক্তিতে এই সময়টা থাকে উদ্দীপ্ত। যে কোনো বাধা পেরিয়ে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে তারুণ্যের শক্তি। এ জন্যই বলা হয়ে থাকে—তারুণ্যই শক্তি। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, আজ আমাদের তরুণ সমাজ অনেক সমস্যায় জর্জরিত। মোবাইল গেম আসক্তি তারমধ্যে অন্যতম। মোবাইল গেম আসক্তির ফলে জীবনের শক্তিদীপ্ত সময়টা অপচয় হয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তরণ সমাজ ।
মোবাইল গেম আসক্তির ফলে দৈনিক আট-দশ ঘণ্টা সময় অপচয় করার কারণে পড়াশোনা ঠিক মতো করতে পারে না। যার ফলে পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ করছে, রেজাল্ট খারাপ হওয়ার কারণে হতাশায় ভুগছে। পরিবারে তৈরি হচ্ছে অশান্তি। হতাশাগ্রস্ত হয়ে অনেকেই আবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করে। দীর্ঘ সময় মোবাইল ব্যবহার করার ফলে শারীরিক নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়। তারমধ্যে মধ্যে অন্যতম চোখের সমস্যা। অবস্থা এরকম হয়েছে যে, অল্প বয়সেই চোখের ডাক্তারের কাছে গেলে প্রথমেই জানতে চায় স্মার্টফোন বা মোবাইল ব্যবহার করে কি না। দীর্ঘ সময় এমনকি গভীর রাত পর্যন্ত মোবাইলে গেম খেলার ফলে স্বাস্থ্য ঠিক থাকে না। মানসিকভাবেও নানা সমস্যায় ভুগতে থাকে। মোবাইল গেম আসক্তরা একা থাকতে পছন্দ করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, একনাগাড়ে দীর্ঘ সময় মোবাইল গেম খেলা এবং একা থাকার কারণে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়।
আমরা মানুষ সেই আদিকাল থেকেই সামাজিক জীব হিসেবে সমাজে একত্রে বসবাস করে আসছি। সমাজের আর সবার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে হয় এবং সমাজের কাজে অংশগ্রহণ করতে হয়। কিন্তু মোবাইল গেম আসক্তির ফলে তরুণরা এই যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে না। ফলে তারা সমাজ থেকে আস্তে আস্তে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, ফলশ্রুতিতে একটা শক্তিশালী সমাজ কাঠামো গড়ে উঠতে বিঘ্ন ঘটছে।
মানুষের অন্যান্য মৌলিক চাহিদার মত, বিনোদনও প্রয়োজন। কারন মানসিক অবসাদ দূর করতে বিনোদনের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই বলে বিনোদনের নামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট করার কোনো মানে নেই। তারুণ্যের শক্তি কাজে লাগাতে সময় নষ্ট করা রোধ করতে হবে। দেশের দায়িত্বশীল মহল কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে মোবাইল গেমে অযথা সময় নষ্ট রোধ করে তরুণ সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার্থে তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সুন্দর দেশ তথা পৃথিবী গড়তে ভূমিকা পালন করবে বলে বিশ্বাস করি। একই সাথে আমাদের সকলকে পারিবার থেকেই সচেতন হতে হবে, সন্তানকে সময় দিতে হবে। মাঝেমধ্যে পরিবারের সবাইকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যেতে হবে। আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এমনকি রেডিও টেলিভিশনে এসব বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচার প্রচারণা আরো বেগবান করতে হবে। আমাদের তারুণ্যের শক্তি ধ্বংস না হয়ে, পরিবার, সমাজ তথা দেশের মূল্যবান সম্পদ হয়ে গড়ে উঠুক। মহান রাব্বুল আলামীন আমাদের সুস্থ, সুন্দর ও সুশিক্ষিত জাতি গঠনে সহায়ক হউন (আমিন)।
লেখক- এসকে এম হেলাল উদ্দিন
কবি ও সাহিত্য সংগঠক
চাঁপাইনবাবগঞ্জ।