লেখা: আবির মাহফুজ
২০২৪ সালের জুলাইয়ের আন্দোলন যেন বাঙালির ইতিহাসে এক নতুন আলোকবর্তিকা। একদিকে শহীদের রক্ত, অন্যদিকে এলাকাবাসীর সহমর্মিতা—এই দুইয়ের সম্মিলনে জন্ম নিয়েছিল এক অভূতপূর্ব ঐতিহাসিক মুহূর্ত। আমি ছিলাম সেই আন্দোলনের একজন সামান্য সৈনিক। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নই আমি, আমি এক মাদ্রাসার ছাত্র; তবুও প্রতিদিন সেই আন্দোলনের অংশ হয়ে গেছি—কারণ এটা কেবল ছাত্রদের লড়াই ছিল না, এটা ছিল পুরো জাতির আত্মার চিৎকার।
১. উত্তাল বরিশাল
১৬ জুলাই, সকাল ১১টা। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর যেন প্রতিবাদের আগ্নেয়গিরি। ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা, চারদিক মুখরিত স্লোগানে:
“বদরের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার!” “জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্রসমাজ জেগেছে!”
পুলিশ এসে টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ছোড়ে। কিন্তু আমরা পিছু হটিনি। শেষে তারা সরে যেতে বাধ্য হয়। বিজয়ী চিত্তে সেদিন আমরা চিৎকার করে বলেছিলাম—এ লড়াই থামবে না।
“যে জাতি তার অধিকার আদায়ে রাস্তায় নামে, তাকে আর কোনো শক্তি দমিয়ে রাখতে পারে না।”
২. রক্তাক্ত সহযোদ্ধারা
আমাদের মধ্যে অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। আমি নিজ চোখে দেখেছি এক সহযোদ্ধা কাঁধে গুলি নিয়ে পড়ে যাচ্ছেন। অন্য একজন তার গায়ে বুলেটপ্রুফ কিছু না থাকলেও সামনে এসে তাঁকে বাঁচাতে চেয়েছিল।
“শহীদের রক্ত বৃথা যায় না; তা নতুন প্রজন্মের জন্য স্বাধীনতার বীজ বপন করে।”
৩. আশার রান্নাঘর – আমাদের মা’রা
এলাকার মহিলারা সেদিন এগিয়ে এসেছিলেন গৃহিণী নয়, যোদ্ধার ভূমিকায়। তারা ক্যাম্পাসে নিয়ে এসেছিলেন হাঁড়িকুড়ি, চাল, ডাল। সেখানে আয়োজন হয়েছিল গণরান্নার। আমরা মিছিল থেকে ফিরে তাদের হাতে বানানো ভাত আর ডাল খেয়েছি—তাতে ছিল পরম যত্ন, ভালোবাসা, মাতৃত্ব।
“মানুষের পাশে মানুষই দাঁড়ায়; বিপদের সময় এটাই সবচেয়ে বড় সমর্থন।”
৪. আবু সাঈদ—এক বুক সাহসের নাম
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ, দাঁড়িয়ে ছিলেন আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে। দুই হাত প্রসারিত করে পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দিলেন। রক্তে ভিজে গেল তার শার্ট, রাস্তা, পতাকা। তিনিই হলেন প্রথম শহীদ।
“আত্মত্যাগই আন্দোলনের প্রাণ; শহীদের রক্তেই স্বাধীনতার সূচনা।”
৫. মুগ্ধ—মানবতার প্রতীক
১৮ জুলাই, উত্তরা আজমপুরে, সংঘর্ষের মাঝেও এক তরুণ বারবার পানি দিচ্ছিল আন্দোলনকারীদের। তার নাম মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ—বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস-এর ছাত্র। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান, কিন্তু তার মানবিকতার ছবি আজও আমাদের হৃদয়ে।
“মানবতার সেবায় যারা জীবন দেয়, তারা চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকে।”
৬. অসিম—যে চলে গেল দৃপ্ত কণ্ঠে
যখন মিছিল থেমে যায়, কণ্ঠ থামে না। তেমনই একজন ছিলেন অসিম। পুলিশ যখন বর্বরতার চূড়ায়, তখন তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন কুরআনের আয়াত ঠোঁটে নিয়ে। হাতে ছিল শহীদদের ছবি। গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়েন তিনিও, কিন্তু তাঁর চোখে ছিল প্রশান্তি—তিনি জানতেন, তাঁর মৃত্যু একটি লক্ষ্যকে অর্থবহ করে তুলবে।
“বিশ্বাস আর প্রতিবাদ মিললে, তাতে জন্ম নেয় সাহসিকতার এক নতুন ভাষা।”
৭. স্মৃতিসৌধ—পাথরে খোদাই ইতিহাস
আবু সাঈদের মৃত্যুর পর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে নির্মাণ হয় শহীদদের স্মৃতিসৌধ। ১৭ জুলাই, ৬ ঘণ্টা ধরে রাস্তা অবরোধ করে আমরা দাবি আদায় করি। সেই দিন আবেগে কেঁদেছে আকাশ, কেঁদেছি আমরাও।
“স্মৃতিসৌধ শুধু পাথরের গাঁথনি নয়; তা আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী।”
৮. আমি—একজন নামহীন সৈনিক
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নই, তবুও প্রতিটি দিন আমি ছিলাম রাস্তায়, প্রতিবাদের প্রথম সারিতে। সেদিন বুঝেছিলাম, পরিচয় নয়, আদর্শই মানুষকে একসাথে দাঁড় করায়। আমাদের মুখে স্লোগান, বুকের মাঝে আগুন—তাতেই এগিয়েছে এই বিপ্লব।
“একসাথে চললে পথ কঠিন হলেও গন্তব্যে পৌঁছানো যায়।”
শেষ কথা...
জুলাইয়ের বাতাসে আজও ভাসে আবু সাঈদের চিৎকার, মুগ্ধর কোমলতা, অসিমের বীরত্ব, আর সেই গন্ধে কাঁপে প্রতিটি পলাশ। আমরা তাদের হারাইনি, তারা আমাদের ভিতরেই আছে—জেগে আছে, জাগিয়ে রাখে।
“এই পতাকা কি শুধুই কাপড়? না, একেকটা বুকের লাশ।”
Website: www.ichchashakti.com E-mail: ichchashaktipublication@gmail.com