গভীর রাতে তুফানের ঘুম ভাঙ্গল। চাঁদনির আলো। মৃদু হাওয়া বইছে। বাড়ির পাশেই পুকুর পাড়। এবার তেমন মাছ ছাড়া হয়নি—টাকার সংকট, ছাড়বেই-বা কিভাবে? চোখ থেকে যেন ঘুম হারিয়ে গেছে, বিছানায় আর গা ঘেষতে ভাল লাগছে না। ইচ্ছে করছে—টংগে বসে ডিপ্লোমা বইগুলো ছিড়ে ফেলে, আগুন লাগিয়ে দিতে! কেননা এখন তার কোন প্রয়োজন নেই।
চাকরিটাকে দাসত্ব মনে হয়। বর্তমানে এই দাসত্বটাতেও টাকা দিয়ে কিনে নিতে হয়, এটা যেন নিজের চেতনাকে অন্যের বোতলে বন্দী করে রাখার মতো; অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া। জানি দেশে আর কোনো উদ্যোগক্তা তৈরি হবেনা, এটা মেনে নিয়ে প্রতি নিয়ত প্রার্থনায় মরনকে ডাকে। কবে মৃত্যু হবে আমার, কবে মুক্তি পাব। কতই আর পারিবারিক অশান্তি, খোটা সহ্য করব বলো? ছোট ভাইটা ম্যাট্রিক ফেল। দিনে দিনে বাবার বয়সটা বেড়েই চলেছে, কতই আর বাবার কাঁধে ভর করব?
তুফান এখনো বিয়ে করেনি, নুন আনতে পান্তা ফুরায় সংসারের অবস্থা। সাটিফিকেটটা কি বাক্সে তুলে রাখা পর্যন্তই থাকবে?
হটাৎ মনে হলো কেউ পুকুর পাড়ে আসছে পা টিপেটিপে, তিনিও প্ল্যান করল চুপিচুপি পা টিপে টিকে সেখানে যাওয়ার, ঠিক যেমন ভাবা—তেমন কাজ। তিনি পুকুর পাড়ের কাছাকাছি আসতেই তাঁর নজরে পড়ল প্রতিবেশী সুমনের হাতে কোদাল, ঘাড়ে একটা বস্তা। সুমন এখন, এখানে কি করছে? বস্তায় কি? কোদাল দিয়ে কি করবে? সুমন তো গতবছর ছাগল চুরি করতে ধরা পড়েছিল। তাই সন্দেহ তো একটা থাকবেই, স্বাভাবিক।
তুফান সজনা গাছটার আড়ালে লুকিয়ে তার (সুমন) দিকে নজর দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর থেকে দেখছে সে নিখুঁত ভাবে মাটি খুরছে, এমন ভাবে খুরছে যেন এখন শব্দ না হয়, আর দিনের বেলা কেউ যেন বুঝতে না পারে মাটি খুরা বা মাটিতে কিছু নেই। যেহেতু পুকুর পাড়, মাটি অল্প স্যাঁতস্যাঁতে, তাই মানুষ যদি মাটির দিকে দেখে তাহলে ভাববে মাটির চলটে উঠে গেছে! হয়তো তেমন একটা সন্দেহ করবে না।
সুমন টের পেয়ে আতঙ্কে মালপত্র রেখেই দৌড় দেয়। এভাবে চোরেরা চুরি করা জিনিস কিছু দিনের জন্য গায়েব করে রাখে। পরে গুঞ্জন থেমে গেলে মালপত্রগুলো তাদের হয়ে যায়। আসলেই কি সেগুলো তাদের? ওগুলো তো অন্যের মালপত্র চুরি করে আনা। ব্যতিক্রম থাকতে পারে। আইন এটাকে কি বলে সেটা আমার (তুফান) জানা নেই।
খাদে পড়ে রয়েছে খাদ্য সামগ্রী। পেটের ক্ষুধা তাদের চোরে রূপান্তরিত করেছে। এবং এটা আস্তে আস্তে অভ্যাসে পরিণত। যার পেটের সাথে মনের ক্ষুধা রয়েছে সে কি করবে? মানুষকে ভালবাসা দিয়ে অসৎ পথ থেকে দূরে আনতে হবে, যদি তা দিয়ে না হয় তাহলে ব্যতিক্রম উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে।
তিনি সুমনকে ডাক দিয়ে বলল,”এ এখানে আয়, আজকে তোকে একটা সুযোগ দেওয়া হলো। আমি কাউকে আজকের ব্যাপারে কিছু বলব না, তবে এমন ভুল আর কোন দিন করিস না। যাঁর মালপত্র চুরি করেছিস! যেদিন স্বাবলম্বী হবি, সেদিন তাঁর মালপত্র কিনে দিবি; তিনি না থাকলে তাঁর ছেলে-মেয়ে কিংবা নাতি-নাতনিদেরকে দিয়ে আসবি। তবে চেষ্টায় থাক অল্প কিছুদিনের মধ্যে ফেরত দেওয়ার।” এমন বলা হয়তো সহজ, কেননা সে আমার পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পারবে না, আর আমি তারটা পারব না।
আমাদের দেশের আয়তন যতটুকু, জনসংখ্যার তুলনায় কর্ম, কর্মসংস্থান কম। যেমন- শিক্ষার্থীর চেয়ে শিক্ষক বেশি, ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতা বেশি।
কত আর কাউকে/নিজেকে বুঝ দিব আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছে, ফলাফল পরকালে। যদি সবাই মিলেমিশে থাকত, তাহলে একটি চুলের মত আয়তন গলি দিয়ে হেটে যাওয়া যেত। আসলেই কি দেশে অকাল নাকি এই সমাজটাই অকাল এনেছে? বিচ্ছিন্ন হয়ে কখনো আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করা যায় না।
হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত,”ক্ষুধার জন্য কেউ যদি রুটি চুরি করে তাহলে চোরের নয় বরং রাষ্ট্রপ্রধানের হাত কেটে দাও।” চুরি পথকে বেছে নিতে বাধ্য করে মানুষের নিষ্ঠুর মায়াজাল। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,”যখন অযোগ্য লোকদেরকে রাষ্ট্রীয় কাজ কর্মে নিযুক্ত করা হবে গখন কিয়ামতের অপেক্ষা কর।”