কোনো এক ব্যর্থ প্রেমিকের অভিভাষণ
জাকির আলম
কাউকে ধোঁকা না দিয়েও যে আলবাৎ বেঁচে থাকা যায়, তার জ্বলন্ত প্রমাণ আমি। বারংবার প্রতারণার শিকার হয়েও ভালো ভাবেই তো বেঁচে আছি। বেঁচে থাকতে হয় প্রতিনিয়ত নিজের সাথে যুদ্ধ করে। যার প্রবল ভালোবাসার কাছে পুরো পৃথিবী নত হয়ে যায়, তার ভালোবাসাও একের পর এক চরম অবহেলার শিকার। যখন কেউ বলে তার বাবার রাগের কাছে আগুন পানি হয়ে যায়, তখন তাকে বোঝাতে পারিনি ভালোবাসার কাছে পুরো পৃথিবী হেরে যায়। তার চলে যাওয়ার অজুহাতে অবান্তর কথা বলে ধোঁকা দিয়েছে সে জেনে বুঝেই। কখনো তাকে দেখিনি ভালোবাসার জন্য দিওনা হতে। প্রথম যেদিন তাকে বরপক্ষ দেখতে আসে, সেদিন তার দেহে যে সৌন্দর্য সে ফুটিয়ে তুলেছিলো, সেদিন ঠিক বুঝে গিয়েছিলাম আমি এক মরীচিকার পিছনে এতোদিন ছুটে বেরিয়েছি। মিথ্যে মায়ায় তার নাগাল পেতে চেয়েছি। কখনো পরখ করে দেখিনি এতোটা ছলনাময়ী সে ! বয়সের দিক থেকে তাকে অবলা মনে করলেও সময় মতো জাত খেলোয়াড়ের মতোই ঠিক বুঝিয়ে দিয়েছে খেলায় সে কতোটা পারঙ্গম ! এমতাবস্থায় একদিন তার ফোন কল আসে, সে অবলীলায় বলে দিলো -‘গতকাল আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে, আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও। আমি তোমাকে দেওয়া কথা রাখতে পারলাম না। এখানে বিয়েতে রাজি হওয়া ছাড়া আমার কিছু করার ছিলো না।’ তার মুখের কথা শুনে আমার উপরে যেন আকাশ ভেঙে পড়েছিলো। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম কিছু সময়ের জন্য। ওই অবস্থায় তাকে আমি কি বলবো, সেই কথা আমার মুখে আনতে পারিনি। কতোটা সহজ ভাবে সে আমার জীবন থেকে বিদায় নিলো চিরদিনের জন্য। অথচ একটিবার তার ভাবনার প্রবৃত্তি জাগেনি, বিপরীতে আমার কি হবে ? সান্ত্বনা দিতে গিয়ে সে অকপটে বলেই দিলো, ‘আমার থেকেও তুমি ভালো মেয়ে পাবে। যে কিনা আমার থেকে সে বেশি সুন্দরী হবে।’ তার ওই কথাগুলো আমাকে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করে পোড়ানোর মতোই আঘাত করতে ছিলো। যার পিছনে এতো সময় ব্যয় করলাম, যার অপেক্ষায় থেকে রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিলাম, বিপরীতে পেলাম বিচ্ছেদের অগ্নিদহন। মানুষ এতোটা বেইমান হতে পারে কখনো আমার জানা ছিলো না। কোনোকিছু ভাবতে না পেরে তাকে নিয়ে পালানোর কথা ভেবেছিলাম।
এখানেও আমি ব্যর্থ হয়ে গেলাম। আমি হেরে গেলাম। সে তখন আরো কর্কশ ভাষায় কথা বলে আমাকে পদাঘাত করে দিলো। আমি হয়ে গেলাম দিশেহারা। বিপরীতে সে নতুন মানুষের প্রেমে মজে গেছে। আমার কষ্টে তার কিছু যায় আসেনা। একটু কথা বলতে চাইলে তার ব্যস্ততা বেড়ে যায়। কথা বলার সময় পায় না। ধীরে ধীরে সে আমাকে অচেনা মানুষে পরিণত করতে থাকে। রাস্তায় দেখা হলে কথা না বলা, অন্য দিকে চেয়ে রাস্তা হাঁটা, অন্য মনস্ক হয়ে আমাকে তাচ্ছিল্য করা, এটা তার নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হতে থাকে। তবুও তাকে পাওয়ার আশা আমি ভুলতে পারিনা। তার সাথে কথা না হলে থাকতে পারিনা। খাওয়া-দাওয়ার প্রতি কোনো মন নেই। নিজের প্রতি চরম অনীহা। মিথ্যে আশায় তাকে কাছে পাওয়ার দিন গুনতে গুনতে একদিন সে চলেই গেলো নতুন মানুষের ঘরে। এই যে আমাকে ফেলে তার চলে যাওয়া এতোটুকুও বিচলিত হতে দেখিনি তাকে। কবুল বলার প্রাক্কালেও তাকে পেতে চাওয়া আমি তাকে অবিশ্বাস করতে পারিনি। কচ্ছপের কামড়ের মতো তার অবস্থান আমাকে নিয়ে গেছে নরকের পথে। একাকী বিছানায় শুয়ে তার বিয়ের রাতে এপাশ-ওপাশ করে কেটে গেলো এককোটি বছর সমান দীর্ঘ একটি বীভৎস যন্ত্রণাময় নির্ঘুম রাত। অথচ সে নতুন মানুষের বুকে মাথা রেখে ফুলশয্যা রাত কাটিয়ে দিলো। নতুন মানুষের উষ্ণ আদর, সর্বাঙ্গে ক্রমাগত চুমুর আলিঙ্গন, নাকে নাক ঘষা, চোখে চোখে রেখে চরম সুখে তার কেটে যাওয়া রাত আমাকে ভুলিয়ে দিলো মিলনের একফোটা গরম জলে। পরম তৃপ্তির আমেজে সবকিছু উজাড় করে দিয়ে বাসা বেঁধে নিলো তার বুকে।
এভাবে সুখের মত্ততায় প্রতিটি রাত কাটতে কাটতে একদিন সে গর্ভবতী হয়ে গেলো। নতুন অতিথির মা হতে যাওয়া সে স্বর্গীয় সুখে দিন কাটাতে থাকে। সে ভুলেই যায় তার প্রতারণার কথা। সে নামাজ পড়ে, পর্দা করে, অথচ মানুষকে কষ্ট দিতে সে মোটেও ভুল করেনি। জানিনা তার জায়গা থেকে সে কতোটা সঠিক। তবে তাকে ছাড়া আমি কেমন আছি সে আমার নিয়তি জানে। তাকে না পেয়ে যতোটা কষ্ট পেয়েছি, তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি তার অপমানজনক কথায়। কখনো তাকে আঘাত দিয়ে কথা বলিনি। সবসময় শালীন ভাষায় তার সাথে কথা বলেছি। এটা সে কখনোই আঁচ করে দেখেনি। বেইমানদের কোনো অনুশোচনা নেই। ওদেরকে স্বয়ং সৃষ্টি কর্তাও চিনে উঠতে পারেন না। ওরা স্বার্থের জন্য সবকিছু মুহূর্তের মধ্যেই ভুলে যেতে পারে। পারে বলেই ওদের কোনো কষ্ট নেই। অথচ তাকে ধোঁকা না দেওয়া আমি কষ্ট পাই। তাকে পেতে চাওয়া আমি কষ্ট পাই। তার কাছে আমার ভালোবাসার কোনো মূল্য ছিলো না কোনোদিন। তার দাঁত কেলিয়ে হাসা আজ আমার কাছে চরম অসহ্য লাগে।
তার চেহারা দেখলে আমার শরীর জ্বলে-পুড়ে যায়। বেঁচে থাকার প্রাক্কালে আমি আর তার দেহের ছায়াও দেখতে চাই না। সে ভালো থাকুক এই কামনাই করি। তার প্রতি আমার আর কোনো দাবি-দাওয়া নেই। তার পথ থেকে আমিও সরে গেছি। হয়তো একদিন আমিও তার স্মৃতি ভুলে যাবো। কিন্তু তার অপমানজনক কথা আমি কোনোদিন ভুলতে পারবো না। এটা আমার কলিজায় আঘাত করেছে। চাইলে আমিও পারতাম তার সাথে কর্কশ ভাষায় কথা বলতে। কিন্তু তা বলিনি। নীরবে সয়ে গেছি সব। সময় পেলে আমিও একদিন বলবো। সেদিন সেও কথা বলার ভাষা খুঁজে পাবে না। আমার মতো সেও নীরব মনে সব কথা সয়ে যাবে।
-তাকে দিলাম না অভিশাপ,
করলাম না অপরাধী।
তাকে হারিয়ে ভালো নেই আমি,
চিতার অনলে তাই জ্বলে-পুড়ে কাঁদি।
পাষাণী প্রিয়া আমার একি করিলো,
বিচ্ছেদের আগুনে সে আমায় পোড়াইলো।
বশীকরণ তাবিজ দিয়ে কোথায় লুকাইলো-
বুকের ভিতর তীর মেরে রক্ত ঝরাইলো !