একটি বছর ঘুরে ফিরে আসে ঈদুল আজহা। চাঁদের আলোয় ভেসে আসে আনন্দ, আর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তাকওয়ার সুবাস। ঈদের আগমনে মুসলমানদের হৃদয় ভরে ওঠে খুশিতে। এ আনন্দ শুধু উৎসবের নয়, এটি আত্মত্যাগ, ভালোবাসা, একতা ও সহযোগিতার প্রতীক। কুরবানির মাধ্যমে মুসলমানরা শুধু পশু জবাই করে না, বরং তারা আত্মা থেকে অহংকার, লোভ, হিংসা ও হিংস্রতা দূর করে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজেদের নিয়তকে শুদ্ধ করে।
কুরবানীর অর্থ ও তাৎপর্য
‘কুরবানী’ শব্দটি এসেছে আরবি “কুরবান” শব্দ থেকে যার অর্থ ‘নৈকট্য’। অর্থাৎ, যে কাজের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়, সেটাই কুরবানী। ইসলামী পরিভাষায় কুরবানী হলো নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট নিয়মে নির্দিষ্ট পশু আল্লাহর নামে জবাই করা। হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর স্মরণে এই কুরবানীর বিধান এসেছে, যিনি স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে তার পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-কে আল্লাহর রাস্তায় কুরবানী করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। তাদের এই ত্যাগের নিদর্শনেই আজ মুসলিম উম্মাহ ঈদুল আজহার দিনে পশু কুরবানী করে থাকে।
আত্মিক কুরবানীর গুরুত্ব
আল্লাহ বলেন, “আল্লাহর নিকট পশুর গোশত ও রক্ত পৌঁছে না, বরং তোমাদের তাকওয়া পৌঁছে।” (সূরা হজ, আয়াত ৩৭)। এই আয়াতই প্রমাণ করে, কুরবানীর বাহ্যিক আচার নয়, বরং অভ্যন্তরীণ মনোভাবটাই আল্লাহর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি কুরবানীর সময় নিজের ভেতরের খারাপ গুণাবলী ত্যাগ করতে না পারি, তবে সেই কুরবানী হয় কেবল মাংসের লেনদেন। প্রকৃত কুরবানী হলো নিজের গর্ব, লোভ, হিংসা, হিংস্রতা, আত্মঅহংকার, অন্যায়ের প্রতি আকর্ষণ—সব কিছুকে বিসর্জন দেওয়া।
ধনীদের জন্য কুরবানীর দায়িত্ব
ধনী ব্যক্তিদের জন্য কুরবানী একটি ফরজ বা অবশ্য পালনীয় ইবাদত, যদি তাদের নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে। অর্থাৎ, যাদের কাছে সোনার নির্দিষ্ট পরিমাণ (সাড়ে সাত ভরি) বা রূপা (সাড়ে বায়ান্ন ভরি) বা তার সমমূল্যের সম্পদ থাকে, তাদের জন্য কুরবানী করা জরুরি। ইসলামের এই বিধান ধনীদের উপর একটি সামাজিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। ধনী যদি শুধুমাত্র পশু জবাই করে দায়িত্ব শেষ মনে করেন, তবে তা কুরবানীর মূল শিক্ষাকে অস্বীকার করা হয়।
কুরবানীর অর্থ হলো ত্যাগ। তাই ধনীরা যেন প্রকৃত কুরবানীর শিক্ষা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন—তাঁরা যেন সমাজের গরীব-দুঃখীর পাশে দাঁড়ান, মাংস ও আনন্দ ভাগ করে নেন। একা একা কুরবানী করে, ফ্রিজে গোশত জমিয়ে রাখা ইসলাম সমর্থন করে না। বরং আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, “তোমরা কুরবানীর মাংস তিন ভাগ করো—এক ভাগ নিজের জন্য, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনের জন্য এবং এক ভাগ গরীবদের জন্য।”
গরীবের অধিকার ও কুরবানীর মাংস
কুরবানীর সময় সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি আমাদের মনে রাখতে হবে তা হলো—এই ঈদ গরীবদের ঈদ। কারণ, অনেক গরীব মানুষ সারা বছর গরুর গোশতের মুখ দেখতে পারেন না। কুরবানীর সময় তারা আশায় থাকেন, কেউ একজন তাদের জন্য কিছু মাংস পাঠাবে, তাদের বাচ্চারাও হয়তো স্বপ্ন দেখে ঈদের দিনে একটু গোশত দিয়ে ভাত খাবে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, অনেক ধনী পরিবার কুরবানীর মাংস আত্মীয়দের মধ্যে বিলিয়ে দেয়, ফ্রিজে রেখে দেয়, নিজের জন্য সংরক্ষণ করে, কিন্তু দরিদ্রদের কথা ভাবে না। অনেক এলাকায় এমনও দেখা যায়, গরীব মানুষ দিনশেষে আশায় বসে থাকেন, যদি কেউ একটি ব্যাগে করে সামান্য মাংস দিয়ে যায়। এটি কুরবানীর প্রকৃত উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
অন্যদিকে, গরীবের কুরবানীও গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে প্রশ্ন করেন—গরীব কি কুরবানী করতে পারবে? হ্যাঁ, যদি সে ধার করেও কুরবানী করতে চায়, তাহলে সেটা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত প্রিয় কাজ হবে। তবে তার উপর এটা ফরজ নয়। তবুও যে গরীব একবেলা না খেয়ে হলেও নিজের পরিবার বা সমাজের কারও সঙ্গে কুরবানীতে অংশ নেয়, আল্লাহ তার নিয়তকে জানেন, এবং তার জন্য রয়েছে অপার সওয়াব।
কুরবানীর মাধ্যমে সমাজে সাম্য
কুরবানী মুসলিম সমাজে সাম্যের একটি বড় নিদর্শন। ধনী-গরীব, রাজা-প্রজা, মালিক-শ্রমিক—সবাই একসঙ্গে আল্লাহর রাস্তায় পশু কুরবানী করে এবং তা ভাগাভাগি করে নেয়। এতে করে সমাজে একধরনের ঐক্য গড়ে ওঠে। ঈদের দিনে যদি একজন মানুষও অনাহারে থাকে, তবে সেটা ঈদের চেতনার বিরুদ্ধে যায়। কুরবানীর মাধ্যমে ধনী ব্যক্তি যেমন গরীবদের সহযোগিতা করেন, তেমনি গরীব ব্যক্তিও ঈদের আনন্দে শরিক হওয়ার সুযোগ পান।
আধুনিক সমাজে কুরবানীর চ্যালেঞ্জ
আজকের সমাজে কুরবানী কখনো কখনো ‘প্রতিযোগিতা’ বা ‘অপচয়’-এর রূপ ধারণ করছে। কে বড় গরু কিনবে, কে বেশি দামি পশু আনবে, কে কতো টাকা ব্যয় করলো—এসব নিয়ে প্রতিযোগিতা চলে। মূল উদ্দেশ্য হয় দেখানো, আল্লাহর সন্তুষ্টি নয়। এমনকি কেউ কেউ পশুর ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে বাহবা কুড়াতে চান। এটা কুরবানীর পবিত্রতাকে নষ্ট করে।
আবার, অনেক সময় কুরবানীর মাংস সংরক্ষণ, বণ্টন ও ব্যবস্থাপনার অভাবে অপচয় হয়। কিছু এলাকায় দেখা যায়, ফ্রিজ ভর্তি করে রাখা হয়, আর দরিদ্র মানুষ মাংস না পেয়ে কাঁদে। এটা ইসলামের শিক্ষা নয়। ইসলাম বলে, কুরবানী এমনভাবে করো, যাতে কেউ বঞ্চিত না হয়।
কুরবানীর মাধ্যমে শিক্ষা
কুরবানীর মধ্যে আমাদের জন্য রয়েছে বহু শিক্ষা—
১. আল্লাহর আদেশের প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য। যেমন হজরত ইব্রাহিম (আ.) আদেশ পেয়ে ছেলেকে কুরবানী করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন।
২. ত্যাগের শিক্ষা। নিজের প্রিয় জিনিসকে আল্লাহর নামে উৎসর্গ করা।
৩. ভ্রাতৃত্ববোধ। ধনী-গরীব, পরিবার-প্রতিবেশী সবার মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
৪. সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ। দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানো।
৫. আত্মনিয়ন্ত্রণ। কুরবানীর মাধ্যমে মানুষ শিখে—প্রাণ হত্যা শুধু উৎসব নয়, বরং তা একটি পবিত্র ইবাদত, যেখানে হৃদয়ের পবিত্রতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
কুরবানীর পশু নির্বাচন ও যত্ন
পশু কুরবানীর জন্য সুস্থ, নির্দোষ, নির্ধারিত বয়সের হতে হবে। চোখে সমস্যা, পা ভাঙা, খুবই রোগাক্রান্ত—এমন পশু কুরবানী গ্রহণযোগ্য নয়। অনেক সময় বাজারে অসুস্থ পশু কিনে এনে কুরবানী করা হয়—এটা ইসলামী নির্দেশনার লঙ্ঘন।
পশুর যত্ন, খাওয়ানো, পরিচর্যা—এসবকেও ইবাদতের অংশ হিসেবে দেখা উচিত। কুরবানীর আগ পর্যন্ত পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা ইসলাম সমর্থন করে না।
উপসংহার
কুরবানী কেবল একটি ধর্মীয় আচার নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবোধ। ত্যাগ, ভালোবাসা, মানবতা, সাম্য ও তাকওয়ার শিক্ষা দেয় কুরবানী। ধনী ব্যক্তিদের উচিত—তারা যেন কুরবানীর মাধ্যমে সমাজে গরীবদের পাশে দাঁড়ায়, আত্মপ্রদর্শনের চেয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আল্লাহর সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দেয়। গরীবরাও যেন ঈদের আনন্দে শরিক হতে পারে, এমনভাবেই কুরবানীর মাংস বণ্টন করতে হবে।
সবার জন্য একটিই প্রার্থনা—আল্লাহ আমাদের কুরবানী কবুল করুন, আমাদের হৃদয়কে শুদ্ধ করুন, আমাদের সমাজকে সমৃদ্ধ করুন।
ঈদ মোবারক।
Website: www.ichchashakti.com E-mail: ichchashaktipublication@gmail.com