সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা, নয়নাভিরাম একটি গ্রামের নাম রূপপুর।শহর থেকে অদূরে অবস্থিত হলেও শহুরে সকল সুযোগ-সুবিধাই এখানে বিদ্যমান। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা একটু দুর্বল হলেও এখানকার জীবন যাত্রা বেশ ভালো। ঠিক এমনি একটি পরিবেশে ঠিক ৩৫ বছর পূর্বে এক মৎস্য ব্যবসায়ীর গৃহ আলোকিত করে শুভাগমন ঘটে একটি নির্মল,নিষ্কলঙ্ক, ফুটফুটে সাদা ফুল !কি বলে ডাকি তারে! আচ্ছা! আপাতত তার নাম হোক “কথা!” “কথা” তার ডাকনাম। গল্প কথার মতই কথা’র জীবন কাহিনী। যদিও,সাদা সদৃশ এক ফুলের ন্যায় তুষার শুভ্র সে। বাবা ইসমাইল আলী হাওলাদার ও মাতা সাহেরা বেগমের সর্ব জ্যৈষ্ঠ সন্তান, আদরের দুলালী এই কথা। বাবা-মা’য়ের ভালোবাসার প্রথম ফসল সে। ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো ছোট্ট কথা। শুভ্র সেই ফুলের মতই সুবাস ছড়াতে শুরু করলো তার চারিধারে। শৈশব, কৈশোরের গণ্ডি পেরুনোর পূর্বেই অনেক ভ্রমরই বসতে চেয়েছে এই ফুলে। আস্বাদন করতে চেয়েছে তার স্বাদ,গন্ধ ও পরশকে। পরবর্তীকালে তাদের সুখের নীড়কে আলোকিত করে আরো সুখ সম্ভারে ভাসিয়ে দেয় তার আরো তিনটি ভাই বোন। তবুও, সুখের যাত্রায় যতি বা ছেদ পড়েনি কভু।
দাড়ি বা কমায় কখনো থামেনি জীবনের গতি। কিন্তু,নিয়তি বিধি-বাম! সুখের ঘরে দুখের আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গেল তার বাবার অকাল প্রয়াণ। তিনিই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম, আয়ের উৎস। অতঃপর, সুখ যাত্রায় যতি পড়ল। যাতনার দিনের হলো শুরু। কথা’র উচ্চ মাধ্যমিক আর পড়া হলো না। শহরের মমিন গার্লস স্কুলে পড়ত সে। মাধ্যমিকের পর উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়নরত অবস্থায় তাদের পরিবারে নেমে আসে আকস্মিক এই দুর্ঘটনা। ফলত: জীবন জীবিকার তাগিদে একটি এনজিও-তে চাকুরী নিল কথা। ছোট ভাই বোনদের লেখাপড়া ও সংসারের যাবতীয় খরচাদির দায়ভার একাই বহন করত কথা। নতুন ভাবে, নব্য রূপে জীবন শুরু করার প্রত্যয়ে যাত্রা শুরু করেছিল সবে। এরই মধ্যে সুন্দরী কথা’র উপর দৃষ্টি নিবন্ধ হয় পাশের বাড়ির এক যুবকের। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের একটা মেলবন্ধন গড়ে ওঠে। দুই পরিবারের সম্মতিতে সেটা পরবর্তীতে প্রণয় থেকে পরিণয়ে রূপ পরিগ্রহ করে। বেশ চলছিল তাদের দাম্পত্য জীবন। বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যেই তাদের গৃহে অতিথি হয়ে আসে দুটি ফুটফুটে পুত্র সন্তান। কিন্তু, এই সুখ আর সইল না বেশি দিন তার কপালে। স্বামী আসক্ত হয়ে পড়ল পরনারী’তে। তাকে বিয়েও করে ফেলল সে।
স্বপ্নগুলো যখন সবে ডালপালা বিস্তৃত করছিল, ডানা মেলে উড়তে চাইছিল ঐ অসীম গগনে তখনই এমন একটা দুর্ঘটনার আকস্মিকতা মেনে নিতে পারে নি সে। ফলাফল স্বরূপ ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল হন্তদন্ত হয়ে।পিত্রালয়ে ফিরে এলো সে। শুরু হলো তার জীবনের নতুন রণযাত্রা। অনেক চেষ্টার পর সে চাকরি নিল খুলনা বিসিকের একটি স্বনামধন্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে। আমিও পূর্ব থেকেই চাকুরী করতাম সেখানে। একা সকল কাজ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিলাম একজন লোকবল নিয়োগদানের জন্য। তারই সূত্র ধরে কথা’র অত্র অফিসে যোগদান। প্রথম দর্শনেই তাকে পছন্দ হয়ে যাই আমার। তার রূপের মোহে মোহবিষ্ট আমি ভালোবেসে ফেলি তাকে। এক পলকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আমার পাশের টেবিলে তাকে বসতে দেয়া হলো। আমার চোখের ভাষা হয়তো প্রথমেই বুঝে গিয়েছিল সে। কিন্তু,পরিস্থিতি ও পরিবেশের সাথে সদা যুদ্ধ করে যাকে চলতে হয় তাকে আর যাই হোক এসব প্রণয় ঘটিত ব্যাপার মানায় না। সে নিজেও খুব বাস্তববাদী হয়ে পড়েছিল। যার কারণে আমাকে সে মোটেই পাত্তা দিত না। যদিও পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে তার সাথে আমার একটা সখ্যতা গড়ে ওঠে। বাসার সকলের সকালের খাবার প্রস্তুত করে অফিসে পৌঁছাতে মাঝে মাঝেই একটু দেরি হত তার। এদিকে আমি প্রায় প্রতিদিনই তাকে ফোন করে দ্রুত অফিসে আসতে বলতাম।
কাজের প্রয়োজনের থেকে সেখানে বেশি প্রাধান্য পেত তার প্রতি আমার অকৃত্রিম,অকৃপণ,মায়া-মমতা ও ভালোবাসা। কিছু ক্ষণ আগে যদি দেখা যায়!চোখে হারাতাম তাকে। এরই মাঝে আমাদের মধ্যে আবির্ভূত হলো রাসেল নামের এক নরক যন্ত্রণা। রাসেল আমাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল আমার থেকে কথাকে ভাগিয়ে নেবে যে কোন মূল্যে। সফল হয়েছিল সে। বিষয়টি আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হই সেদিন,যেদিন তারা একই সাথে দুজনেই অফিসে অনুপস্থিত ছিল। প্রমোদ ভ্রমণে গিয়েছিল তারা। অফিসের বাইরে ও প্রায়ই দেখা করত তারা। যাইহোক, বিষয়টি কিভাবে যেন জেনে যায় রাসেলের সহধর্মিনী। রাসেল বিবাহিত একথা বোধহয় জানতো না কথা। ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর তাদের প্রণয় আর পরিণয়ের মুখ দেখেনি। আমিও মনেপ্রাণে খুশি হলাম। কারো পৌষ মাস আর কারো সর্বনাশ! তাতে আমার কিছুই এসে যায় না। এটা যে যুদ্ধ! যুদ্ধে সব কিছুই হালাল। নতুন করে আবার ঝাঁপিয়ে পড়লাম তার মন জয়ের যুদ্ধে। এরই মধ্যে রাসেল চাকুরী ছেড়ে চলে গেল। কিছুদিন পর কথা’ও চলে গেল। অফিসে সকলে ঘটনাটি জেনে যাওয়ায় বিড়ম্বনার হাত থেকে বাঁচতে তাদের এই প্রস্থান। খুব খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার এই অকস্মাৎ প্রস্থানে। মনটা আমার খারাপ ছিল অনেকদিন। মন মরা হয়ে বসে থাকতাম। কিছুই ভাল লাগত না। এরপর অফিস শেষ করে প্রায়ই যেতাম কথা’র স্বপ্নকুটিরে। এখনো যাই। ততদিনে রাসেলের কথা ভুলতে বসেছিল সে। আমি যাই,দর্শে আসি আমার স্বপ্নকে। নিবিষ্ট একাগ্রতায়,অপলক নয়নে চেয়ে থাকি তার পানে। নয়নে মোর স্বপ্ন আঁকি তারে নিয়ে। যদি ঘর বাঁধা যায়!
যদি জগতের সকল সুখ এনে তার দুঃখে প্রলেপ দেওয়া যায়! অমাবস্যার নিম রজনীতে আঁধারের ঘোর কেটে গেলে যেমনি অপার আলোয় উদ্ভাসিত হয় পুরো ধরা,তেমনি কালে-ভাদ্রে হলেও আমার সুতীব্র প্রচেষ্টায় আসে তার মুখাবয়বে হাসির ঝিলিক, নীলাভ চাঁদোয়ার নীল আলোর বিচ্ছুরণে জগত ভুলানো নয়ন জুড়ানো হাসির দীপ্তি,ফুটে উঠে আলোর রেখা। এই লোভ সংবরণ করি কি করে! আবার এক চিলতে মেঘ এসে আঁধার করে দিয়ে যায় সবকিছু। মনটা তার ব্যাকুল হয়ে যায়,ঢেকে থাকে সতত অজানা নানা শঙ্কা, হাজারো উৎকণ্ঠায়,,,,।
কথা’রকথা
রকিবুল ইসলাম।