ওয়ালিমার পরিচয় ও হুকুম
এস এম জাকারিয়া
মীরসরাই, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ
ওয়ালিমা (আরবি: وليمة ওয়ালিমাহ), বা বিবাহ ভোজ, ইসলামী বিবাহের দুইটি ঐতিহ্যগত অংশের মধ্যে দ্বিতীয়। ওয়ালিমা নিকাহ (আরবি: نكاح) বা বিয়ের অনুষ্ঠানের পর সম্পন্ন করা হয়। আর ওয়ালিমা শব্দটি আলওয়ালাম থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যেটির অর্থ একত্রিত করা। এটি দ্বারা আরবীতে ভোজকে নির্দেশ করা হয়। বিয়ের পরদিন বা পরবর্তী সময়ে সুবিধামতো নিকটতম সময়ের মধ্যে ওয়ালিমা করা বিধেয়। তবে তিন দিনের মধ্যে করা উত্তম। যেকোনো প্রকার খাদ্যদ্রব্য দিয়ে ওয়ালিমা করা যায়। ওয়ালিমা একটি ইবাদত। এক দিন ওয়ালিমা করা সুন্নত, দুই দিন ওয়ালিমা করা মুস্তাহাব, তিন দিন ওয়ালিমা করা জায়েজ। ( সহীহ মুসলিম )
রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে ওয়ালিমা করেছেন এবং সাহাবিদের করতে বলেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) জয়নব বিনতে জাহাশ (রা.)-কে বিয়ে করার পরদিন ওয়ালিমা করেছিলেন। ( জামেউ’ল বুখারি )
রাসুলুল্লাহ (সা.) সাফিয়াহ (রা.)-কে বিয়ের পর তিন দিন যাবৎ ওয়ালিমা খাইয়েছিলেন। ( মুসনাদে আবু ইয়ালা )
ওয়ালিমার দাওয়াত দিতে হবে ধনী-গরিব সর্বস্তরের লোকজনকে। বেছে বেছে শুধু ধনী বা বিত্তশালীদের নয়। যেমন হাদীসের ভাষ্যমতে….
عَنْ أَبِـيْ هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنَّهُ كَانَ يَقُوْلُ : ” شَرُّ الطَّعَامِ طَعَامُ الْوَلِيمَةِ يُدْعَى لَهَا الْأَغْنِيَاءُ وَيُتْرَكُ الْفُقَرَاءُ وَمَنْ تَرَكَ الدَّعْوَةَ فَقَدْ عَصَى اللهَ وَرَسُوْلَهُ ﷺ “.
আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলতেন, ’সবচেয়ে নিকৃষ্টতম খাবার হল সেই অলীমার খাবার যার জন্য ধনীদেরকে দাওয়াত দেওয়া হয় এবং বাদ দেওয়া হয় গরীবদেরকে। আর যে ব্যক্তি দাওয়াত গ্রহণ করল না সে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নাফরমানী করল “।(বুখারী ও মুসলিম )
মুসলিমের আরেক বর্ণনায় আছে, আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
” شَرُّ الطَّعَامِ طَعَامُ الْوَلِيمَةِ يُمْنَعُهَا مَنْ يَأْتِيهَا وَيُدْعَى إِلَيْهَا مَنْ يَأْبَاهَا وَمَنْ لَمْ يُجِبِ الدَّعْوَةَ فَقَدْ عَصَى اللهَ وَرَسُوْلَهُ “.
” সবচেয়ে নিকৃষ্টতম খাবার হল সেই অলীমার খাবার; যাতে তাদেরকে আসতে নিষেধ করা হয় (বা দাওয়াত দেওয়া হয় না), যারা তা খেতে চায় এবং যার প্রতি তাদেরকে আহবান করা হয়, যারা তা খেতে চায় না। আর যে ব্যক্তি দাওয়াত গ্রহণ করে না সে ব্যক্তি আল্লাহ ও তদীয় রসূলের না ফরমানী করে “।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ : “ شَرُّ الطَّعَامِ طَعَامُ الْوَلِيمَةِ يُمْنَعُهَا مَنْ يَأْتِيهَا وَيُدْعَى إِلَيْهَا مَنْ يَأْبَاهَا وَمَنْ لَمْ يُجِبِ الدَّعْوَةَ فَقَدْ عَصَى اللَّهَ وَرَسُولَهُ ” .
আবূ হুরায়রাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ” নিকৃষ্টতম খাদ্য হল ওয়ালীমার খাদ্য যেখানে আগমনকারীদের বাঁধা দেয়া হয়। আর অনিচ্ছুকদের দাওয়াত দেয়া হয়। যে ব্যক্তি দাওয়াতে সাড়া দেয় না সে আল্লাহ এবং তার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাফরমানী করল “। ( সহীহ মুসলিম )
ওয়ালিমা খুব বেশী জাঁকজমকপূর্ণ, আড়ম্বর অনুষ্ঠান হতে হবে তা নয়, বরং অনাড়ম্বর ও সাদাসিধা অনুষ্ঠানকেই হাদীসে রাসূল সাঃ দ্বারা বরকতময় বলা হয়েছে। কারণ ওয়ালিমায় অতিরিক্ত ব্যয় করা কিংবা খুব উঁচুমানের খাবারের ব্যবস্থা করা জরুরি নয়। বরং সামর্থ্য অনুযায়ী খরচ করাই সুন্নত আদায়ের জন্য যথেষ্ট। যেমন নিম্নোক্ত হাদীস থেকে বোঝা যায়…….
” عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ أَنَّ عَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ عَوْفٍ جَاءَ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَبِهِ أَثَرُ صُفْرَةٍ فَسَأَلَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَخْبَرَهُ أَنَّهُ تَزَوَّجَ فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَمْ سُقْتَ إِلَيْهَا فَقَالَ زِنَةَ نَوَاةٍ مِنْ ذَهَبٍ فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَوْلِمْ وَلَوْ بِشَاةٍ “.
আনাস ইবন মালিক (রাঃ) হইতে বর্ণিত, ” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমীপে আবদুর রহমান ইবন আউফ ইবন আউফ (রাঃ) উপস্থিত হইলেন। তাহার (দেহে ও বস্ত্রে) হলুদ বর্ণের সুগন্ধি দ্রব্যের চিহ্ন ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাকে ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। আবদুর রহমান ইবন আউফ তাহাকে জানাইলেন তিনি জনৈক আনসার মেয়েলোককে বিবাহ করিয়াছেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি উহাকে কত মহর প্রদান করিয়াছ ? তিনি বলিলেনঃ এক নাওয়া (نَوَاةٍ) খেজুরের বীচি পরিমাণ স্বর্ণ। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিলেনঃ ওয়ালীমাকর একটি বকরী দিয়া হইলেও “। ( মুয়াত্তা মালেক )
عَنْ إِسْحَقَ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ أَبِي طَلْحَةَ أَنَّهُ سَمِعَ أنس بْنَ مَالِكٍ يَقُولُ : “إِنَّ خَيَّاطًا دَعَا رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِطَعَامٍ صَنَعَهُ قَالَ أَنَسٌ فَذَهَبْتُ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى ذَلِكَ الطَّعَامِ فَقَرَّبَ إِلَيْهِ خُبْزًا مِنْ شَعِيرٍ وَمَرَقًا فِيهِ دُبَّاءٌ قَالَ أَنَسٌ فَرَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَتَتَبَّعُ الدُّبَّاءَ مِنْ حَوْلِ الْقَصْعَةِ فَلَمْ أَزَلْ أُحِبُّ الدُّبَّاءَ بَعْدَ ذَلِكَ الْيَوْمِ “.
ইসহাক ইবন আবদুল্লাহ ইবন আবি তালহা (রহঃ) আনাস ইবন মালিক (রাঃ)-কে বলিতে শুনিয়াছেন, ” জনৈক দরজী এক প্রকারের খাদ্য প্রস্তুত করিয়া উহা আহারের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দাওয়াত করিলেন। আনাস (রাঃ) বলেনঃ সেই দাওয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে আমিও গিয়াছিলাম। তাহার নিকট পেশ করা হইল যবের রুটি ও ঝোল, যাহাতে কদু ছিল।
আনাস বলেনঃ আমি পেয়ালার আশপাশ হইতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কদু অনুসন্ধান করিতে দেখিলাম। সেই দিন হইতে আমি সর্বদা কদু পছন্দ করি “।
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, আব্দুর রহমান বিন আউফ (রাঃ) যখন বিয়ে করেছেন তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বলেন: “একটি ছাগল দিয়ে হলেও তুমি ওয়ালিমার আয়োজন কর”। ( সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম )
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খায়বার ও মদিনার মাঝে তিনদিন অবস্থান করেছিলেন। এ সময় তিনি সাফিয়্যাকে (রাঃ) বিয়ে করেন। আমি মুসলমানদের সকলকে তাঁর বিয়ের ওয়ালিমার দাওয়াত দিলাম। সে ওয়ালিমাতে রুটি বা গোশত কিছুই ছিল না। সে ওয়ালিমাতে কিছুই ছিল না; শুধু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিলাল (রাঃ) কে চামড়ার চাটাই বিছানোর নির্দেশ দিলেন; চাটাই বিছানো হল। এরপর সে চাটাই এর ওপর খেজুর, পনির ও ঘি ছিটিয়ে দেয়া হল।” ( সহীহ বুখারী )
ওয়ালিমার দাওয়াত পেলে উপস্থিত হওয়া ওয়াজিব। রাসূল সাঃ বলেছেন, ” তোমাদের কাউকে যখন ওয়ালিমার দাওয়াত দেয়া হয় তখন সে যেন সে দাওয়াতে যায়”। ( সহীহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম )
عَنْ نَافِعٍ، عَنِ ابْنِ عُمَرَ، أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ : “ إِذَا دُعِيتُمْ إِلَى كُرَاعٍ فَأَجِيبُوا ” .
ইবনু উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ” যখন তোমাদের বকরীর পায়া খাওয়ার দাওয়াত দেয়া হয় তখন তোমরা তাতে সাড়া দিও “। ( সহীহ মুসলিম )
আল্লাহ তায়া’লা আমাদের সকলকে সঠিকটা বুঝার ও আমল করার তাওফিক দান করুন।