মো ফাত্তাহান আলী
ঠিকানা : বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়,রংপুর।
এই তো কদিন হলো—ছোট পিঙ্কে রঙের ঘরটার উপর দিয়ে ভো করে উড়ে গেল এক জোড়া শালিক। প্রায়ই এ বাড়িতে তাদের যাতায়াত। সকাল হলে, মায়ের খাবার বাড়ানো শেষ হতে না হতেই, তারা দ্বিতীয়বারের মতো হাজির হয়—যেন বাড়িরই ওরা আপনজন কেউ।
আমাদের বাড়িতে বেশি লোক থাকে না বললেই চলে—কয়েকটা আমগাছ, ঝাপড়ি-ঝাপড়ি সবুজ ঝোপ, আর একটি মাটির ঘর আর মা। আমি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার আগে থেকেই তাদের সঙ্গে আমাদের আতিথেয়তার সম্পর্ক। সময়ের সাথে এই সম্পর্ক আরও জমজমাট হয়ে উঠেছে।
তারা দুইজন—দুটো শালিক। ভোর হলেই আসে, খায়, চলে যায়—কিন্তু প্রতিবারের আসা-যাওয়ার মাঝখানে যেন কিছু রেখে যায়। কী সেটা ভাষায় ধরা যায় না। মা সেটা বুঝতে দেরি করেন না বোধ হয়। নাহলে এমন রাগী স্বভাবের মানুষ তারা বিরক্তিকর ডাক, ডানা ঝাপটানো, আর অবিরাম উড়াউড়ি দেখে বিরক্ত হতেন না। বরং মা চুপচাপ খাবার রেখে দেন বারান্দার কোনায়।
মা আমার মতো এতটা “প্যাঁচ কেটে চলা” মানুষ নন—তিনি সোজা মানুষ। এই সোজা মানুষটাকে কোনোভাবেই ফাঁদে ফেলে কিছু বের করা যেত না। কিন্তু শালিকদের ক্ষেত্রে তিনি একেবারেই ভিন্ন—তাদের জন্য মায়ের মনে আলাদা জায়গা আছে।
একদিন বুঝতে পারলাম, তাদের বাসা আমাদের মাটির ঘরের দেওয়ালের ভেতরেই। বৃষ্টির দিনে সেখান থেকে ছোট ছোট ডাক ভেসে আসে, গরমের দুপুরে শোনা যায় ডানা মেলার শব্দ। যেন আমাদের একচালা বাড়িটাই তাদেরও এক আঙ্গিনা।
একদিন একজন পাখি শিকারি আসে, মা তাকে বেশ বকুনি দিয়ে বংশ রক্ষা করেন। হয়তো তারা আগেই এসেছিল, মা খবরটা একটু দেরিতে পেয়েছিলেন। কারণ পরের দিন সকালে কেবল একটা পাখিই এসেছিল। পুরো রাত নিঃশব্দে কেটেছে, মাঝ রাতে দু’একটা ভয়ঙ্কর শব্দ শোনা গিয়েছিল। এমন শব্দে মায়ের কাপুনি দিয়ে জ্বর আসত—কারণ তিনি সাহসী হলেও ভীতু।
সকালে মা বুঝতে পারলেন। খুবই দুঃখ পেলেন। একবার আমাকে বললেন,
“ওদের সংসারেও আজ কান্নার রোল।”
ছেলে মানুষের মতো করে বললেন,
“আজ আমরা চুলা ধরব না, ওরাও তো আমাদের বাড়ির একজন।”
আমি হাসি হেসে ফেললাম, যেন মা বুঝতে না পারেন।
হ্যাঁ, মায়ের নিয়মেই সেদিন চুলা জ্বলল না।
আঙিনায় রোদ পড়লেও ঘরের ভেতরটা যেন ঠান্ডা হয়ে ছিল। বারান্দার কোণে খাবারের থালা ঢাকা অবস্থায় পড়ে রইল—যা প্রতিদিন সকালে শালিকদের জন্য রাখা হয়। কিন্তু সেদিন কেউ এল না।
মা বারবার আঙিনার দিকে তাকাচ্ছিলেন, যেন সেই পরিচিত ডানার শব্দ ভেসে আসবে। আমি দেখছিলাম, মায়ের চোখে অদ্ভুত এক শূন্যতা—যেন নিজের পরিবারের কেউ হারিয়ে গেছে।
বিকেলের দিকে একা শালিকটিকে আমগাছের ডালে বসে থাকতে দেখলাম। তার ডাকেও আজ কোনো সুর ছিল না, কেবল ভাঙা ভাঙা শব্দ। কিছুক্ষণ পর সে উড়ে গেল পশ্চিম আকাশের দিকে। আমি জানি, হয়তো সে আর আসবে না প্রতিদিনের মতো—কিন্তু আসার পথটা হয়তো ভুলবে না কোনোদিনই।
সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে আকাশের এক কোণে হালকা চাঁদ উঠল। মা তখন চুপচাপ আঙিনায় বসে ছিলেন। আমি গিয়ে পাশে বসতেই তিনি ধীরে বললেন,
“বাপ, সব প্রাণীরই ঘর লাগে—তাদের হারালে বুক খালি হয়ে যায়।”
তারপর এক ভোরে, সকালের সূর্যের ফেলকানো হাসির আলোয়, সেই শালিকটিকে আবার দেখা গেল। বারান্দার বাঁশের ডাপে চুপচাপ বসে আছে। মা একটু হেসে উঠলেন, খাবার ছিটিয়ে দিলেন। কথা বললেন না, পাখিটাও ডাকল না—ভো করে উড়ে গেল আকাশের দিকে।
আজ মনে হলো, মায়ের মন হয়তো একটু ভালো।
কিন্তু আমি বুঝি—এ ভালো লাগার ভেতরে একটা সাবধানী দূরত্ব আছে। যেন মা নিজের মনকে বলছেন,
"আবার খুব বেশি ভরসা করো না, আবার হারাতে হতে পারে।"
সেদিন বিকেলে মা বারান্দায় বসে সুতো কাটছিলেন। পাশেই রোদে শুকোতে রাখা ছিল শীতের লেপ। হঠাৎ দেখি, সেই একলা শালিকটি এসে মায়ের কাছে দাঁড়িয়ে রইল। এবারও ডাকল না, শুধু চোখ মেলে তাকিয়ে রইল। মা চুপচাপ হাত থামিয়ে তার দিকে তাকালেন। কয়েক সেকেন্ড যেন সময় স্থির হয়ে থাকল।
তারপর মা ধীরে বললেন,
"তুই থাকিস, তোর বাসা থাকুক—যতদিন পারিস ফিরিস এখানে। এই ঘর তো শুধু আমাদের নয়, তোরও।"
শালিকটি মাথা একটু কাত করল, যেন বুঝতে পারছে। তারপর হঠাৎ ডানা মেলে উড়ে গেল।
সন্ধ্যা নামার সময় মা আঙিনায় এসে দাঁড়ালেন। আমগাছের ডালে একা শালিকটিকে দেখলাম আমিও।
মা ধীরে বললেন,
"দেখছিস বাপ, জীবনের সব শূন্য জায়গা ভরানো যায় না, কিন্তু তবুও কিছু সম্পর্ক থেকে যায়—যারা ফিরে আসে, এমনকি যখন তাদের আর কেউ ফেরার জন্য ডাকে না।"
আমি কিছু বললাম না। শুধু মনে হচ্ছিল, আজ মায়ের ভেতরে একটা নতুন শান্তি জন্ম নিয়েছে—যেন শালিকটা ফিরে এসে শুধু তার বাসা নয়, মায়ের মনেও আবার একটা ডানা মেলে দিয়েছে।
কথা না বলে আমি পড়তে বসলাম। বইয়ের পাতায় চোখ থাকলেও মন বারবার চলে যাচ্ছিল বারান্দার দিকে। দূরে, গোধূলির লাল আভায়, আমগাছের ডালে শালিকটার ছায়া দেখা যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে ডানা নেড়ে জায়গা বদলাচ্ছিল, যেন যাচ্ছেও না, থাকছেও না—দু’য়ের মাঝামাঝি এক অদ্ভুত দ্বিধায় আটকে আছে।
মা ধীরে ধীরে উঠলেন, ভেতরে গিয়ে চুলা ধরালেন। দীর্ঘদিন পর সেই শব্দটা ঘর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। রান্নার গন্ধে একটা উষ্ণতা ফিরল, যা গত ক’দিন ধরে যেন হারিয়ে গিয়েছিল।
আমি মনে মনে ভাবলাম—যতক্ষণ মায়ের চুলা জ্বলছে, ততক্ষণ এই ঘরে কেউ সত্যিই একা নয়।
রাত গভীর হলে বাইরে চাঁদের আলোয় উঠোন ভেসে যাচ্ছিল। ঘুম আসছিল না আমার। হঠাৎ শুনতে পেলাম—বারান্দায় হালকা ডানার শব্দ। জানলা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি—সেই শালিকটা, খাবারের থালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।
আজ প্রথমবার সে ডাক দিল—খুব হালকা, খুব সংক্ষিপ্ত, কিন্তু তাতে ছিল অদ্ভুত এক নিশ্চয়তা।
Website: www.ichchashakti.com E-mail: ichchashaktipublication@gmail.com