বাইরে তখন প্রবল বৃষ্টি।
আকাশ কেঁদে চলেছে যেন অদৃশ্য কোনো দুঃখের ভারে। জানালার কাঁচে টপটপ শব্দে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে — প্রতিটি ফোঁটা যেন অর্পণের হৃদয়ে শব্দ তোলে। ঘরের আলো খুব ম্লান। একটা ছোট্ট টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে, বালিশের গায়ে হেলান দিয়ে অর্পণ চুপ করে বসে আছে। চোখে-মুখে বিষণ্নতা, ভেতরে শব্দহীন এক ঝড়।
আজ ১৪ জুলাই।
এই তারিখটার প্রতি অর্পণের এক অদ্ভুত রকমের সংবেদনশীলতা তৈরি হয়েছে গত এক বছরে। কারণ এই দিনেই রোদেলা চলে গিয়েছিল তার জীবন থেকে।
রোদেলা — তার জীবনের সবচেয়ে প্রাণবন্ত মানুষটা। যে মেয়েটা হেসে উঠলে মনে হতো জানালার পাশে বসে বসন্ত ঢুকছে ঘরে।
কিন্তু সে বলেছিল,
— “তুমি খুব চুপচাপ অর্পণ। একাকী মানুষ। আমি তোমাকে ভালোবাসি, কিন্তু তোমার নিঃশব্দ জীবনটাকে ভালোবাসি না।”
অর্পণ তখন কিছু বলেনি।
শুধু জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল। আজকের মতই।
রোদেলা চলে যাওয়ার পরে অর্পণের জীবন থেমে গেছে। না, সে মরেনি। কিন্তু বেঁচেও যেন বেঁচে নেই। এক কাপ চা বানিয়ে বসে থাকে, কেউ নেই পাশে গল্প করার, কেউ নেই যে ঠাণ্ডা চায়ের বদনাম করবে।
হঠাৎ কলিং বেল বাজল।
বৃষ্টি হচ্ছে, তাই একটু চমকে উঠল অর্পণ।
দরজার ছিটকিনি খুলে দাঁড়িয়ে গেল সে।
দরজার ওপাশে এক মেয়ে। ভেজা চুলে পানি টপটপ করছে। ছাতা হাতে থাকলেও, শরীর ভিজে একেবারে গলগলে।
মেয়েটি একটু হেসে বলল,
— “ভালোবাসেন না নিশ্চয়ই কেউ, তাই চমকে গেছেন?”
অর্পণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,
— “মানে?”
— “আমি পাশের ফ্ল্যাটে উঠেছি আজকেই। ছাদে উঠেছিলাম। হঠাৎ বৃষ্টি। কোনো উপায় না পেয়ে আপনার দরজায় এলাম। যদি একটু… চা পান করতেন?”
অর্পণ একটু হেসে বলল,
— “চা তো করি, কিন্তু কেউ থাকে না যে পাশে বসে খাবে। আজকে একজন আছে বটে।”
মেয়েটি হেসে ভেতরে ঢুকল। তার হাসি অদ্ভুত রকমের পরিচিত ঠেকল অর্পণের কাছে।
মেয়েটির নাম ছিল — সায়রি।
চায়ের কাপ ঠোঁটে নিয়ে সে বলল,
— “আপনার রুমে শব্দ নেই একটুও। কিন্তু বৃষ্টি শব্দ করে আপনাকে জাগিয়ে রাখে, তাই না?”
অর্পণ বলল,
— “হ্যাঁ। এই বৃষ্টিই এখন একমাত্র সঙ্গী। বৃষ্টি মানে রোদেলার স্মৃতি।”
সায়রি চুপ করল কিছুক্ষণ। তারপর বলল,
— “জানেন, আমি একা থাকতে পারি না। ছাদের বৃষ্টি ভালো লাগে, কিন্তু পাশে কেউ না থাকলে বুকের ভেতরটা হঠাৎ হাহাকার করে ওঠে। তাই হয়তো এই দরজা খুলে ফেললাম।”
অর্পণ চুপ করে রইল। একটা অদ্ভুত নরম অনুভূতি যেন বুকের ভেতর সরে সরে যাচ্ছে। অনেক দিন পর — খুব, অনেক দিন পর — কেউ এসে তার চুপ করে থাকা জীবনটাতে একটু শব্দ যোগ করল।
সন্ধ্যেটা ধীরে ধীরে গভীর হল। ঘরের জানালায় বৃষ্টির শব্দ কমে এল একটু একটু করে।
সায়রি বিদায় নেবার আগে বলল,
— “আচ্ছা, কাল কি আবার এক কাপ চা পাবো?”
অর্পণ জানালার দিকে তাকিয়ে বলল,
— “বৃষ্টি নামলে তো চা চাই–ই। আর এখন জানি, কেউ একজন পাশে বসে থাকবে।”
সায়রি হেসে চলে গেল।
অর্পণ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইল।
বৃষ্টিটা থেমে গেছে।
কিন্তু তার ভিতরের একাকীত্বে যেন নতুন কারও পায়ের শব্দ পড়েছে।
— ৩০ শে আষাঢ়, দ্বিপ্রহর
শেষ।