1. admin@ichchashakti.com : admin :
রবিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:০০ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
কুড়িগ্রামের লেখিকা নিপা’র কিছু কবিতাংশ “স্বপ্নের ছোঁয়া সাহিত্য পুরস্কার-২০২৫” এ শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জিতলো ‘চা জগত’ – বই  সাহিত্য আড্ডা ও সাফারি পার্ক ভ্রমণ ২০২৫ ইচ্ছাশক্তি সাহিত্য পরিবার আয়োজিত সাহিত্য আড্ডা ও সাফারি পার্ক ভ্রমণ ২০২৫ ইচ্ছাশক্তি সাহিত্য পরিবারের অনুষ্ঠান রৌমার, কুড়িগ্রাম -এর নবীন লেখিকা নিপা’র দুইটি কবিতা অর্ধ নারীশ্বর —– প্রীতম ভট্টাচার্য শেষ যাত্রা —- প্রীতম ভট্টাচার্য অর্পিতা সাহিত্য লাইব্রেরী-এ.এস.এল এর প্রাথমিকভাবে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন যাঁরা… ক্যান্সারে আক্রান্ত মাও. এনামুল হাসান ফারুকীর পাশে দাঁড়ালো আল ইরশাদ ফাউন্ডেশন –

একটি স্যান্ডেলের গল্প

  • প্রকাশের সময় : শনিবার, ৩ মে, ২০২৫
  • ৭৮ বার প্রতিবেদনটি দেখা হয়েছে

মোঃ নূরনবী ইসলাম সুমন

শিক্ষার্থী, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার্থী ২০২৪-২৫

ইচ্ছাশক্তি আইডি নং: 0020220648    

 

ছেলেটার পায়ের নিচে একটা পুরোনো স্যান্ডেল। ডান পায়েরটা খানিকটা ফেটে গেছে, মাঝে মাঝে হাঁটতে গেলে জিভের মতো বের হয়ে আসে। বৃষ্টির দিনে স্লিপ করে, শুকনো দিনে ধুলোর সাথে মিলেমিশে যায়। স্যান্ডেলটা যেন তার জীবনের প্রতিচ্ছবি।

 

নাম তার নূর। নামের সঙ্গে মিল নেই তার জীবনযাত্রার। সে ঢাকায় এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির স্বপ্ন নিয়ে। গ্রাম থেকে এসেছে একটানা সাড়ে ছয় ঘণ্টার বাস জার্নি করে। ঢাকায় নেমেই প্রথম যে বিষয়টা তাকে চিন্তায় ফেলে দিল, সেটা ছিল থাকার জায়গা। চাচার বাসায় উঠলেও বুঝে গেল, সে এখানে বেশিদিন থাকতে পারবে না। চাচার মুখে কোনো অভাবের কথা না থাকলেও মুখভঙ্গি বুঝিয়ে দিলো—অবাঞ্ছিত কেউ ঢুকে পড়েছে তার গৃহে।

 

নূরের মা একজন গৃহকর্মী। গ্রামে গৃহস্থদের বাসায় কাজ করেন, বাবার মৃত্যু হয়েছে তিন বছর আগে। মা দুই সন্তানকে আগলে রেখেছেন বুকের রক্ত দিয়ে। মা সব সময় বলে, “মানুষ হইলে তোরে কেউ থামাইতে পারবে না। স্যান্ডেল ছিঁড়লে নতুন জোড়া কিনতে হইবে, কিন্তু স্বপ্ন ছিঁড়লে কি কেউ ফেরাইতে পারে?”

 

নূর সেই স্বপ্ন নিয়েই ঢাকায়। কোচিং শুরু করলো, কিন্তু এখানে সবকিছু টাকার হিসেবের বাইরে কিছু নয়। বাড়িভাড়া, কোচিং ফি, খাওয়া—সব মিলিয়ে তাকে রীতিমতো লড়াই করতে হয়। একেকটা দিন যেন একেকটা যুদ্ধে জয়ী হয়ে বাঁচা। সে পড়ে, রাস্তায় হেঁটে কোচিংয়ে যায়, কখনো বাসে না উঠেই ৪ কিলোমিটার হেঁটে যায়। ওই স্যান্ডেলেই।

 

একদিন ক্লাস শেষে বের হচ্ছিল, তখন এক সহপাঠী বলে, “দোস্ত, তোর ওই স্যান্ডেলটা দেখলে আমার আফসোস হয়।”

 

নূর হেসে বলে, “স্যান্ডেল ফাটা হইলে কী হইছে? আমার স্বপ্ন তো এখনো টের পাই নাই ফাটার শব্দ!”

 

সেই রাতে নূর ফিরে আসে চাচার বাসায়। দরজা খুলতেই চাচি মুখ গোমড়া করে জানিয়ে দিলেন, “আগামী মাস থেকে আর থাকতে পারবা না। বাড়িওয়ালা সমস্যা করছে।” কথাটা নূর বুঝে—চাচার গৃহে তার জন্য জায়গা নেই। পরদিন সকালেই সে বেরিয়ে পড়ে, আর ফিরে যায় না। ব্যাগে তার কিছু কাপড়, বই, আর সেই পুরোনো স্যান্ডেল।

 

সে আশ্রয় খোঁজে সহপাঠীদের হোস্টেলে, কোনো ঘর না পেয়ে এক মাদ্রাসার গেটে রাত্রিযাপন করে। তারপর খুঁজে পায় একটি ছাত্রাবাস, যেখানে সে পরিচয় গোপন রেখে একজন ঝাড়ুদারের কাজ করে বিনিময়ে রাতে থাকার সুযোগ মেলে। দুপুরে কোচিং, রাতে পড়াশোনা, আর ভোরবেলায় ঝাড়ুদার—এই ছিল তার জীবনচক্র।

 

এভাবে চলতে চলতে একদিন সে ঢুকে পড়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাঝখানে। প্রথমদিকে সে শুধু দূর থেকে দেখে, পরে এক রাতে সে নিজেই একটি স্লোগান তোলে— “বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর!”

 

সেই রাতেই পুলিশের লাঠিচার্জ হয়। নূর দৌঁড়ায়, কিন্তু স্যান্ডেলের ফাটা পাটায় পা আটকে পড়ে যায়। পুলিশের লাঠি তার পিঠে পড়ে, মাথায় লাগে। রক্তে ভেসে যায় মুখ, কিন্তু সে স্লোগান থামায় না। তার ছবি ছাপা হয় পত্রিকায়—“একজন নূরের গল্প” শিরোনামে।

 

সেই ছবি দেখে দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ মেসেজ করে, কেউ টাকা পাঠায় বিকাশে। কেউ বলে—“তুই আমাদের আশা।” কিন্তু নূর তখনও সেই ছেঁড়া স্যান্ডেল পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট পার হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

 

অবশেষে পরীক্ষার দিন আসে। প্রশ্ন দেখে সে হেসে ওঠে—সব তার জানা। তিন ঘণ্টা সে যুদ্ধে লিপ্ত থাকে কলমের সৈনিক হয়ে। বেরিয়ে এসে বলে, “আজকে স্যান্ডেল না, পায়ের নিচে ছিল স্বাধীনতা।”

 

দুই মাস পরে রেজাল্ট বের হয়। প্রথম মেরিটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পায় সে। মা কান্নায় ভেঙে পড়ে। গ্রামের স্কুলের ছাত্ররা বলে—“দেখো, ওই ভাইটা স্যান্ডেল পরে ইতিহাস বানাইছে।”

 

নূর পুরোনো স্যান্ডেলটা এখন যত্ন করে রেখে দিয়েছে। মাঝে মাঝে সেটা হাতে নিয়ে বলে, “তুই না থাকলে আমি আজকের আমি হতাম না।”

 

তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনও সহজ ছিল না। প্রথম বর্ষে উঠে এসেই আবাসনের সমস্যায় পড়ে আবার। হলে জায়গা পায় না। তখন সে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়া বন্ধ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। জীবনটা আবার নতুনভাবে শুরু করে।

 

শিক্ষকরা তার জীবন দেখে বিস্মিত হন। ক্লাসে যখন তার পরিচয় উঠে আসে, সে বলে—“আমি একটা স্যান্ডেল থেকে এসেছি।” ছাত্ররা হাসে, শিক্ষকরা স্তব্ধ থাকে। সেমিস্টারে প্রথম হওয়ার পর শিক্ষক তাকে বলেন—“তুমি আমাদের গর্ব। তুমি প্রমাণ করেছ, পা যদি মাটিতে থাকে তবে মাথা পৌঁছাতে পারে আকাশে।”

 

নূরের ঘরে তখন অনেক বই, মঞ্চে বক্তৃতা, সাহিত্য সভায় কবিতা। অথচ তার ড্রয়ারের এক কোণে সেই ছেঁড়া স্যান্ডেল। সে ছেলেটি এখন দেশের অন্যতম তরুণ লেখক। তার আত্মজীবনী ‘একটি স্যান্ডেলের গল্প’ ছাপা হয়। বইমেলায় দীর্ঘ লাইন। মানুষের ভালোবাসা, স্বপ্নের জয়গান।

 

একদিন এক সাংবাদিক তার সাক্ষাৎকার নিতে এসে জিজ্ঞেস করে—“আপনার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা কী?”

 

নূর হেসে উত্তর দেয়, “এক জোড়া ফাটা স্যান্ডেল। যেটা আমাকে শেখায়—জীবন সবসময় আরামদায়ক হয় না, কিন্তু যদি তুমি নিজের স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরো, তবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ও তোমার পায়ের নিচে আসবে।”

Facebook Comments Box
এই ক্যাটাগরির আরও খবর
© স্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ ইচ্ছাশক্তি
Theme Customized By Shakil IT Park