আজ ঈদ। মহল্লার মসজিদের মাইকে ফজরের আজান হচ্ছে, মা শুভ’কে ডেকে বলল তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে ওজু করে বাবার সাথে মসজিদে নামাজ পরতে যাও,ঘুম থেকে উঠতে আলসেমি হলেও শুভ যথারীতি ঘুম থেকে উঠে ওজু করে বাবার সাথে নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে রওনা হলো, সকাল বেলা মসজিদ থেকে ফজরের নামাজ শেষ করে শুভ বাসায় ফিরে বাবা- মাকে সালাম করলেন।
আজ শুভ খুব খুশি, শুভ’র মনে আনন্দের জোয়ার বইছে। শুভ ‘কে বলল, যাও গোসল করে নাও, শুভ
কিছুক্ষন পর গোসল সেরে বাসায় এসেছে। মা রীনা বেগম যত্ন করে তার মাথা ও পুরা শরীর মুছে দিচ্ছেন।ইতিমধ্যে শুভ বলল, মা আমি আব্বার সাথে ঈদগাহ মাঠে নামাজ পড়তে যাব। এর আগে শুভ ঈদগাহে গিয়েছে তবে ছোট মানুষ হিসেবে নামাজ পড়ার উদ্দেশ্য যায়নি, মা বললেন, শোনো ছেলর কথা! ঈদগাহে তো অবশ্যই যাবে,
তবে দুষ্টোমি করা যাবে না বাবার সাথে গিয়ে নামাজ পড়ে আবার বাসায় ফিরে আসবে! উচ্চ স্বরে মা রীনা বেগম গড়গড় করে একদমে কথা গুলো বলল!মায়ের উচ্চ স্বরে কথা গুলো শুনে শুভ মুখভার করে দাঁড়িয়ে রইলো। সে তার পাঁচ বছর বয়সে কখনো ঈদগাহ মাঠে নামাজ পড়তে যায়নি।
মা শুভকে ঈদের নতুন পাঞ্জাবি পড়িয়ে দিলেন। পাঞ্জাবি টা একটু ছোট হয়েছে। তবে শুভ’র গায়ে বেশ মানিয়েছে। মা দীর্ঘ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। ভাগ্য ভালো সময়মতো তিনি কাপড়ের ঝুড়ি থেকে এ পাঞ্জাবি টা পেয়েছিলেন। ঝুড়ির এক কোনায় পড়ে ছিল। অনেক দিনের পুরনো কিন্তু পূর্বে কোনদিন সেই পাঞ্জাবি টা শুভ পড়েনি। তিনি সেই পাঞ্জাবি টা নিয়ে দিনভর খেটে ভালো করে সেলাই করে বোতাম লাগিয়ে ঠিক করে রেখেছেন । মা রীনা বেগম হাসিমুখে ছেলের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন। বাহ্ আমার ছেলেকে পাঞ্জাবিতে আজ বেশ সুন্দর মানিয়েছে।
তিনি ছেলেকে কোলে নিয়ে আদর করলেন, শুভ মুখ ভার করে আছে।মুখ ভার করে আছো কেন বাবা? ঈদের জামা পড়ে কেউ মন ভার করে থাকে?শুভ’র একটুও ভালো লাগছে না। সবাই সাদা কত সুন্দর সুন্দর পাজামা পাঞ্জাবী পড়ে ঈদগাহে যাচ্ছে। অথচ তারও সেরকম কোন ভালো পাঞ্জাবি বা পাজামা নেই।
এদিকে বাবা টয়লেট থেকে বের হয়ে এলেন।। শুভ’কে দেখে বললেন, বাহ পাঞ্জাবি তো খুব সুন্দর হয়েছে!মা রীনা বেগম বললেন, শুভ তোমার সাথে ঈদগাহ নামাজ পড়তে যাবে।
বাবা একটু মুচকি হেসে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে! তোমাকে আজ ঈদগাহে নামাজ পড়তে নিয়ে যাব।
কিছুক্ষনের মধ্যে তারা ঈদগায় রওনা হলেন। তবে ঈদগাহ মাঠ শুভ’র বাড়ি থেকে খুব দূরে নয় অল্প দু তিন মিনিটের পথ।
শুভ ঈদগাহ মাঠে এসে অভিভুত হয়ে গেল। পাজামা পাঞ্জামী পড়ে শত শত মানুষ লাইন করে বসেছে। ইমাম সাহেব আরবীতে কী যেন পড়ছেন। সে বাবার সাথে মাঠের ভেতর ঢুকে পড়ল। কিছুক্ষনের মধ্যে নামাজ শুরু হল। ।নামাজ উপলব্ধি করার মতো বয়স যদিও শুভ’র হয়নি তাই
।সে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। শত শত মানুষ একসাথে উঠে দাঁড়াচ্ছে, বসে পড়ছে। সে এক দেখার মতো দৃশ্য।
নামাজ শেষে বাবর সাথো শুভ হাঁটতে শুরু করলো,
শুভ বাবাকে জিজ্ঞেস করলো? বাবা আমরা কোথায় যাব?
বাবা বললো আমার এক বন্ধুর বাসায়। ওদের ঈদ মোবারক জানিয়ে আসি।
কিছুক্ষন পরই তারা বিরাট এক বাড়ির সামনে এসে পৌঁছল। বাড়ির সামনে লোহার বড় গেট। শুভ বাবার পেছনে পেছনে ঢুকল। দরজার কাছে এসে বাবা কলিংবেল বাজালেন। কেউ দরজা খুলছে না। বাবা আরও কয়েকবার কলিং বেল চাপলেন। হঠাৎ দরজা খুলে গেল। শুভ চমকে উঠল। ঘরের ভেতর তার বয়সের একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে কারুকাজ খচিত সুন্দর একটা অ্যাশ কালের পাঞ্জাবি। মনে হচ্ছে ছোট্ট এক রাজপুত্র । রাজপুত্র বোধহয় একটু বিরক্ত হলো। সে একটু মুখ বাঁকা করে ঘরের ভেতরে চলে গেল। কিছুক্ষন পর এক লোক এসে তাদেরকে গেস্ট রুমে নিয়ে গেল।
বসার ঘরের প্রতিটা জিনিস অনেক সুন্দর ! বড় বাক্সের মধ্যে কিছু রঙ্গিন মাছ ছোটাছুটি করছে। শোকেসে অনেক সুন্দর করে সাজানো আছে হরেক রকমের খেলনা এবং অপূর্ব সুন্দর একটি পুতুল, পুতুলটির চোখ ঘন নীল। মনে হচ্ছে অবাক চোখে তাকে দেখছে। শুভ অবাক চোখে সবকিছু দেখছে। শুভ’র অবাক হওয়া দেখে বাবা মিটিমিটি হাসছেন। ভাবখানা এমন, এই হচ্ছে আমার বন্ধুর বাড়ি, ভালো করে দেখে নাও।
অনেকক্ষন পর বাবার সেই বড়লোক বন্ধু এলেন।
আরে মজনু যে…বাবা সাথে সাথে উঠে দাড়ালেন। ওনার সাথে হাত মেলালেন এবং কোলাকুলি করলেন। ভদ্রলোক বেশ নিরাসক্ত ভঙ্গিতে কোলাকুলি করলেন। তারপর শুভ’র দিকে তাকিয়ে বললেন, এটি কে?
বাবা বললেন আমার ছেলে শুভ , শুভ আঙ্কেলকে সালাম কর।
শুভ ভদ্রলোককে সালাম করল। উঠে দাড়াতেই তিনি একশত টাকার একটা চকচকে নোট বাড়িয়ে দিলেন।
শুভ ইতস্তত বোধ করছে, সে তার এই ছোট্ট জীবনে ঈদের সেলামী দশ টাকার বেশী কোনদিন পায়নি। সে ভয়ে ভয়ে বাবার চোখের দিকে তাকাল।
বাবা বললেন, নাও বাবা নাও , লজ্জা কিসের? আঙ্কেল যখন আদর করে দিচ্ছেন।শুভ হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিল।
সবাই সোফায় বসেছে। তাদের সামনে লাচ্চা-সেমাই, ফিরনি দেয়া হয়েছে। শুভ ফিরনি মুখে দিয়ে হতবাক, এত মিষ্টি! আসার সময় মা তাকে চামিচে করে ফিননি খাইয়ে দিয়েছিলেন। ভাতের চাল-গুড় দিয়ে তৈরী সেই ফিরনি এত স্বাদ লাগেনি।
ভদ্রলোক বাবার সাথে খুব একটা কথা বলছেন না। মোবাইলে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। একসময় তিনি উঠে দাড়ালেন।
মজনু তুমি তাহলে থাক। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে যেও। আমাকে একটু বেরোতে হবে।ভদ্রলোক চলে গেলেন। বাবা কিছুক্ষন ইতস্তত করে উঠে দাঁড়ালেন।
বাড়ি থেকে বের হয়ে সে বাবার সাথে অনেকক্ষন চুপচাপ হাঁটল তারা। বাবা মজনু মিয়া একসময় শুভ’কে বললেন, বাবা তোমার ঐ সালামির টাকাটা এখন আমাকে দাও। কিছুদিন পর তোমাকে আমি দুই’শ টাকা দিয়ে দিব।
শুভ একটু ইতস্তত করে, লাভের আশায় টাকাটা দিয়ে দিল। বাবা সেই টাকা নিয়ে একটা মুদি দোকানে ঢুকলেন। সেমাই, চিনি, দুধ কিনলেন। তারপর দু’জনে বাসায় রওনা হলাম।
এরপর দেখতে দেখতে দীর্ঘ পঁচিশ বছর কেটে গেছে। শুভ’র জীবনে এখনো ঈদ আসে। তবে আগের মতো নয়, অনেক আনন্দ আর খুশী নিয়ে প্রতিবার ঈদের আগে সে রাজশাহী, বগুড়ার ভিইপি শপিংমল যায় শপিং করতে। নিজের জন্য, মা, ভাই-বোন ও আত্মীয় স্বজন এমনকি পাড়া প্রতিবেশী গরীব দুঃখী অসহায় পরিবারে জন্যও ট্টলি ভর্তি করে জামা-কাপড় কিনে। শপিং করতে করতে সে কখনো কখনো ক্লান্ত হয়ে বারে বসে চা- কফি, কোল্ড ড্রিংকস খায়। তখন হঠাৎ মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠে তার অসহায় বাবার চেহারা। তার চোখ জলে ভিজে উঠে। তার সেই অসহায় বাবা আর নেই! হারিয়ে গেছেন চিরতরে!!!