মোঃ নূরনবী ইসলাম সুমন
ইসলামকে অনেকেই সাধারণত ধর্ম হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। তবে এটি কেবল একটি ধর্ম নয়; বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। “ইসলাম” শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ “সালাম” থেকে, যার অর্থ শান্তি, নিরাপত্তা, এবং আত্মসমর্পণ। এর মর্মার্থ হলো আল্লাহর নির্দেশের প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে শান্তি অর্জন। ইসলাম মানুষের জন্য একটি চিরন্তন হেদায়েত, যা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা প্রদান করে।
বস্তুত, “ধর্ম” শব্দটি মানুষের মনগড়া কিছু বিশ্বাস ও প্রথার প্রতি ইঙ্গিত দেয়। ইসলামের সঙ্গে এ ধারণার কোনো মিল নেই। ইসলামকে “দ্বীন” বলা হয়, যার অর্থ জীবনব্যবস্থা। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত একটি সমন্বিত পদ্ধতি, যা মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতিটি দিককে সঠিক পথে পরিচালিত করে। এই প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করব কেন ইসলাম কেবল ধর্ম নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা।
ইসলাম: ধর্মের চেয়ে অনেক বেশি:
ধর্ম সাধারণত কোনো বিশেষ আচার-অনুষ্ঠান বা উপাসনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এটি মানুষকে কেবল আত্মিক বিষয়বস্তুতে সীমাবদ্ধ রাখে। অন্যদিকে ইসলাম এমন একটি ব্যবস্থা, যা কেবল উপাসনার ক্ষেত্রেই নয়, বরং মানব জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে বিস্তৃত। এটি অর্থনীতি, রাজনীতি, আইন, সমাজনীতি, পারিবারিক জীবন, এমনকি ব্যক্তিগত আচরণও নিয়ন্ত্রণ করে।
ইসলামের মূল ভিত্তি হলো কুরআন এবং হাদিস। কুরআন আল্লাহর বাণী, যা মানুষের জীবনের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ সংবিধান। এতে বর্ণিত বিধানগুলো কেবল উপাসনার জন্য নয়; বরং মানুষের সামাজিক আচরণ, অর্থনৈতিক লেনদেন, এবং রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নির্দেশিকা প্রদান করে।
মানুষের মনগড়া ধর্ম বনাম আল্লাহর জীবনব্যবস্থা:
মানুষের তৈরি ধর্ম সাধারণত সীমাবদ্ধ এবং পরিবর্তনশীল। প্রতিটি যুগে, সমাজের চাহিদা ও পরিস্থিতি অনুযায়ী এসব ধর্মের নিয়মাবলি বদলে যেতে পারে। অন্যদিকে, ইসলাম আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত, যা সর্বজনীন ও চিরন্তন। এর বিধানগুলো সব যুগ, সমাজ এবং পরিস্থিতির জন্য প্রাসঙ্গিক।
ইসলামের অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো এর সরলতা, যৌক্তিকতা এবং কার্যকারিতা। এটি মানব জীবনের প্রতিটি প্রয়োজনের জবাব দেয়। উদাহরণস্বরূপ, ইসলাম অর্থনীতিতে সুদকে নিষিদ্ধ করেছে, যা সমাজে অর্থনৈতিক শোষণ রোধ করে। একইভাবে, এটি নারী-পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করে এবং সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন করেছে।
ইসলামের সংবিধান কুরআন:
কুরআন ইসলামের মূল ভিত্তি। এটি একমাত্র গ্রন্থ, যা অপরিবর্তিত অবস্থায় টিকে আছে এবং চিরকাল থাকবে। কুরআন মানবজাতির জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবনপদ্ধতির নির্দেশিকা। এতে ব্যক্তিগত আচার-আচরণ থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার সব নির্দেশিকা রয়েছে।
কুরআন আল্লাহর নির্ভুল বাণী। এটি মানুষের জন্য এমন একটি সংবিধান, যা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শন করে। উদাহরণস্বরূপ:
নবী মুহাম্মদ (সা.) ইসলামের বাস্তব উদাহরণ:
নবী মুহাম্মদ (সা.) ইসলামের শিক্ষাকে জীবনে বাস্তবায়ন করেছেন। তিনি ছিলেন মানবতার জন্য চূড়ান্ত আদর্শ। তার জীবনের প্রতিটি দিক থেকে জানা যায়, ইসলাম কেবল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।
তিনি মক্কায় একটি নৈতিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছেন, যেখানে সাম্য, ন্যায়বিচার এবং মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করা হয়েছিল। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন সাহস দেখিয়েছেন, তেমনি শত্রুদের প্রতি ক্ষমাশীলতার উদাহরণও রেখেছেন। তার জীবন আমাদের শেখায় কীভাবে ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করা যায়।
ইসলামের সার্বজনীনতা:
ইসলাম কোনো নির্দিষ্ট জাতি, গোষ্ঠী বা ভূখণ্ডের জন্য নয়। এটি সবার জন্য প্রযোজ্য। ইসলামের বিধানগুলো পৃথিবীর যে কোনো সমাজ ও সংস্কৃতিতে কার্যকর। এটি কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নয়; বরং প্রতিটি যুগে প্রাসঙ্গিক।
বর্তমান যুগে ইসলামের শিক্ষা ও বিধান আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক অবক্ষয়, অর্থনৈতিক শোষণ, এবং নৈতিক অধঃপতনের এ সময়ে ইসলামই একমাত্র পথ, যা মানুষকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারে।
ইসলামের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি:
ইসলামকে অনেক সময় ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়। পশ্চিমা সমাজে ইসলামকে “উগ্রবাদ” বা “মৌলবাদ” হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা দেখা যায়। তবে এটি ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা নয়। ইসলাম শান্তি, ন্যায়বিচার এবং মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে।
ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো দূর করতে হলে আমাদের ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা প্রচার করতে হবে। কুরআনের বার্তা এবং নবী (সা.)-এর জীবনকে মানুষকে জানাতে হবে।
ইসলাম কেবল একটি ধর্ম নয়; এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা দেয়। এটি কোনো মনগড়া মতবাদ নয়; বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত চিরন্তন হেদায়েত।
বর্তমান যুগে ইসলামের শিক্ষাগুলো বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ইসলামের পথে ফিরে আসলে পৃথিবী শান্তি, ন্যায়বিচার এবং মানবতার আদর্শে প্রতিষ্ঠিত হবে।
তাই ইসলামকে সঠিকভাবে বোঝা এবং মেনে চলা আমাদের দায়িত্ব। ইসলামকে শুধুমাত্র ধর্ম হিসেবে সীমাবদ্ধ না রেখে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করাই আমাদের মুক্তির একমাত্র পথ।