মোঃ নূরনবী ইসলাম সুমন
তাবলীগ ইসলামের মূলভিত্তি এবং নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। এটি কেবল আল্লাহর পথে আহ্বান জানানো নয়; বরং এটি এমন একটি প্রচেষ্টা যা একজন মানুষের জীবন, আত্মা, এবং সমাজকে গভীরভাবে পরিবর্তন করতে সক্ষম। তবে তাবলীগের কাজ যখন সঠিক আলেমদের হাত থেকে বিচ্যুত হয়ে স্বার্থবাদী বা দুনিয়াবি উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়, তখন তা ইসলামের সৌন্দর্য ক্ষুণ্ন করে এবং উম্মাহর জন্য ফিতনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এখানে আমি অধম বিষয়টি গভীরভাবে আলোচনা করব।
তাবলীগ: একটি পবিত্র দায়িত্ব
তাবলীগ শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ ‘বালাগ’ থেকে, যার অর্থ হলো পৌঁছানো। ইসলামের দৃষ্টিতে তাবলীগ মানে হলো আল্লাহর বানী মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এটি এমন একটি দায়িত্ব যা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর কোনো না কোনোভাবে বর্তায়। তাবলীগের মাধ্যমে মানুষকে কল্যাণের পথে আহ্বান করা হয়, সৎ কাজের আদেশ দেওয়া হয় এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়।
কোরআন ও হাদিসে তাবলীগের গুরুত্ব:
১. পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে:
> “তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, সৎ কাজের নির্দেশ দেবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে।”
(সূরা আলে ইমরান: ৩:১০৪)
২. নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন:
> “তোমরা যদি একটি আয়াতও জানো, তবে তা অন্যদের কাছে পৌঁছে দাও।”
(সহিহ বুখারি)
এই দাওয়াতের কাজ সম্পূর্ণভাবে নৈতিক এবং আত্মিক উন্নতির জন্য। এটি কোনো দুনিয়াবি স্বার্থে করা হয় না।
তাবলীগের সঠিক দিকনির্দেশনা: হক্কানী আলেমদের ভূমিকা
হক্কানী আলেমরা ইসলামের প্রকৃত পথপ্রদর্শক। তারা কোরআন ও হাদিসের সঠিক জ্ঞান ধারণ করেন এবং নিজেদের জীবনযাপনেও তা প্রতিফলিত করেন। তাদের মাধ্যমেই তাবলীগের কাজ সঠিকভাবে পরিচালিত হয়।
হক্কানী আলেমদের বৈশিষ্ট্য:
১. আল্লাহভীরুতা:
হক্কানী আলেমরা আল্লাহর প্রতি ভয় এবং ভালোবাসা নিয়ে কাজ করেন। তাদের প্রতিটি কাজের লক্ষ্য থাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।
২. কোরআন ও হাদিসে পারদর্শিতা:
তারা কোরআন ও হাদিসের গভীর জ্ঞান রাখেন এবং সঠিক ব্যাখ্যা দেন। তারা কোনোভাবেই ধর্মকে অপব্যবহার করেন না।
৩. নম্রতা ও বিনয়:
তারা সর্বদা নম্র আচরণ করেন। তাদের জীবন সাদাসিধে এবং অহংকার মুক্ত।
৪. দুনিয়াবি লোভ থেকে মুক্ত:
তারা কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা, অর্থ বা ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য তাবলীগের কাজ করেন না।
তারা মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য, শান্তি এবং ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করতে কাজ করেন।
স্বার্থবাদী আলেম: ইসলামের শত্রু
স্বার্থবাদী আলেমরা ধর্মকে নিজেদের ব্যক্তিগত বা দুনিয়াবি স্বার্থে ব্যবহার করেন। তারা তাবলীগের কাজকেও নিজেদের লক্ষ্য পূরণের হাতিয়ার বানিয়ে ফেলেন।
স্বার্থবাদী আলেমদের বৈশিষ্ট্য:
১. দুনিয়াবি লোভ:
তারা ক্ষমতা, অর্থ বা সামাজিক মর্যাদার জন্য ধর্মের অপব্যবহার করেন।
২. কোরআন ও হাদিসের অপব্যাখ্যা:
তারা কোরআন ও হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করেন।
৩. ফিতনা সৃষ্টি:
তারা মুসলমানদের মধ্যে দলাদলি এবং বিভেদ সৃষ্টি করেন।
৪. চরিত্রহীনতা:
তাদের জীবনে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা প্রতিফলিত হয় না।
তারা ইসলামের সৌন্দর্য ক্ষুণ্ন করেন এবং উম্মাহকে বিভ্রান্ত করেন।
তাবলীগের কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে হক্কানী আলেমদের অনুসরণ জরুরি
তাবলীগের কাজ কেবল বক্তব্য দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি এমন একটি দায়িত্ব যা মানুষের আত্মা ও চিন্তার জগতে পরিবর্তন আনতে পারে। তবে এর জন্য সঠিক নেতৃত্ব জরুরি।
তাবলীগের কাজের সঠিক পদ্ধতি:
১. আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা:
তাবলীগ কেবল আল্লাহর জন্য করতে হবে। এর মধ্যে কোনো দুনিয়াবি স্বার্থ থাকা উচিত নয়।
২. কোরআন ও হাদিসের ওপর নির্ভর করা:
তাবলীগের সবকিছু কোরআন ও হাদিসের আলোকে করতে হবে।
৩. সামাজিক শান্তি বজায় রাখা:
তাবলীগের মাধ্যমে সমাজে শান্তি, সৌহার্দ্য এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৪. হক্কানী আলেমদের নেতৃত্বে কাজ করা:
তাবলীগের কাজ হক্কানী আলেমদের দিকনির্দেশনায় করলে তা সঠিক পথে পরিচালিত হবে।
স্বার্থবাদী আলেমদের থেকে দূরে থাকার কারণ
স্বার্থবাদী আলেমদের অনুসরণ করলে মানুষ শুধুমাত্র বিভ্রান্ত হয় না; বরং তারা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা থেকে দূরে সরে যায়। এটি দুনিয়া এবং আখিরাত উভয়ের জন্য ধ্বংসাত্মক।
স্বার্থবাদী আলেমদের প্রভাব:
১. ধর্মের অপব্যাখ্যা:
তারা মানুষের মধ্যে কোরআন ও হাদিসের ভুল ধারণা ছড়িয়ে দেয়।
২. ফিতনা সৃষ্টি:
তাদের কারণে সমাজে ফিতনা, বিভেদ এবং দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।
৩. আখিরাতের ক্ষতি:
তাদের প্রভাবে মানুষ ইসলামের প্রকৃত পথ থেকে সরে গিয়ে আখিরাতের সফলতা হারায়।
৪. ধর্ম নিয়ে রাজনীতি ও ব্যবসা করা
চলুন একটু যেনে আসি ধর্ম নিয়ে স্বার্থবাদী নামদারি আলেমরা কেমন ব্যবসা করে :
স্বার্থবাদী আলেমরা অনেক সময় ধর্ম ব্যবসা করেন। যখন একজন আলেম বা ধর্মীয় নেতা ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শের প্রতি সত্যিকার নিষ্ঠা এবং আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্যের পরিবর্তে, নিজের ব্যক্তিগত লাভ বা স্বার্থের জন্য ধর্মের উপর ভরসা করেন, তখন তাকে ধর্ম ব্যবসায়ী বলা হয়। এসব আলেমেরা ধর্মীয় জ্ঞান ও প্রভাবের অপব্যবহার করে সাধারণ জনগণের কাছ থেকে অর্থ, সম্মান, এবং ক্ষমতা লাভের চেষ্টা করেন।
ধর্ম ব্যবসা মূলত যখন ধর্মের নামে বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক লাভ, সামাজিক মর্যাদা বা ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করা হয়, তখন সেটা ইসলামের দৃষ্টিতে চরমভাবে নিন্দনীয়। ইসলামে ধর্মের প্রতি একনিষ্ঠতা, বিশ্বস্ততা এবং আধ্যাত্মিক উদ্দীপনা গুরুত্ব পায়, তবে যদি এই দায়িত্বের পরিপন্থী কাজ হয়, তখন সেটি ধ্বংসাত্মক হতে পারে।
স্বার্থবাদী আলেমদের কিছু বৈশিষ্ট্য:
স্বার্থবাদী আলেমরা ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করার বদলে, নিজের আর্থিক বা সামাজিক স্বার্থের দিকে বেশি মনোযোগ দেন। তাদের প্রধান লক্ষ্য থাকে ক্ষমতা ও প্রভাব অর্জন।
তারা ধর্মীয় অনুষ্ঠান, ওয়াজ মাহফিল, মসজিদ বা মাদ্রাসা পরিচালনা করে অর্থ উপার্জন করতে চায়। ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতার পরিবর্তে এটি এক ধরনের ব্যবসা হয়ে দাঁড়ায়।
তারা কোরআন ও হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করে। কখনও কখনও তারা নিজেদের লাভের জন্য ধর্মীয় বিধানকে বিকৃত করে।
ধর্মীয় মর্যাদা, মসজিদ বা মাদ্রাসা পরিচালনা করে নিজেদের সামাজিক অবস্থান শক্তিশালী করার চেষ্টা করা হয়।
ধর্মীয় সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান গড়ে ধর্মের নামে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করা, যা সরাসরি ইসলামিক কাজের জন্য ব্যবহৃত না হয়ে অন্য কাজে চলে যায়।
> ধর্ম ব্যবসার প্রভাব:
ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ক্ষুণ্ন হয়:
এই ধরনের ধর্ম ব্যবসায়ীরা ইসলামকে একটি পণ্য হিসেবে ব্যবহার করেন, যা ধর্মীয় শিক্ষা ও আদর্শের বিকৃতি ঘটায়।
মানুষের আস্থা নষ্ট হয়:
সাধারণ মানুষ যখন ধর্ম ব্যবসায়ীদের কর্মকাণ্ড দেখে, তখন তাদের ইসলামের প্রতি আস্থা কমে যায়। তারা ধর্মকে একটি রাজনৈতিক বা আর্থিক হাতিয়ার হিসেবে দেখতে শুরু করে।
সমাজে বিভেদ সৃষ্টি হয়:
ধর্মীয় নেতা হওয়ার জন্য কেউ কেউ নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করেন। এভাবে ইসলামের শান্তির বার্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আখিরাতে শাস্তি:
আল্লাহ তাআলা কোরআনে স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, যারা আল্লাহর বিধান বিক্রি করবে বা ধর্মের নাম ব্যবহার করে দুনিয়ার স্বার্থ হাসিল করবে, তাদের জন্য আখিরাতে কঠিন শাস্তি রয়েছে।
ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্ম ব্যবসার পরিণতি:
ইসলামে ধর্মের সঙ্গে বাণিজ্য করা বা দুনিয়াবি লাভের জন্য ধর্মীয় কাজ করা নিষিদ্ধ। কোরআন ও হাদিসে এই বিষয়ে বেশ কিছু কঠোর সতর্কতা রয়েছে। আল্লাহ তাআলা এবং নবী করিম (সা.) স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, যারা ধর্মীয় কাজে স্বার্থপরতা দেখায়, তারা আখিরাতে বড় শাস্তির সম্মুখীন হবে।
কোরআনে বলা হয়েছে:
> “তোমরা আমার আয়াতকে তুচ্ছ মূল্যে বিক্রি করো না, এবং শুধুমাত্র আমাকে ভয় করো।”
(সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত ৪১)
এছাড়া, নবী করিম (সা.) বলেছেন:
> “যে ব্যক্তি তার জ্ঞানের জন্য শুধুমাত্র দুনিয়া অর্জনের উদ্দেশ্যে কাজ করবে, তার জন্য জান্নাতের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে।”
(সহিহ মুসলিম)
ধর্ম ব্যবসা থেকে মুক্ত থাকার উপায়:
আলেমদের উচিত তাদের কাজের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং মানুষের কল্যাণে সীমাবদ্ধ রাখা। তারা যেন কখনও ধর্মকে বিক্রি না করেন।
মুসলমানদের উচিত সঠিক এবং হক্কানী আলেমদের কাছ থেকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করা, যারা দুনিয়াবি স্বার্থ থেকে মুক্ত।
যে কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা কর্মকাণ্ডের মধ্যে স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা থাকতে হবে, যাতে কোনো প্রকার ব্যক্তিগত স্বার্থের প্রবণতা না থাকে।
জনগণকে বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করতে হবে, যাতে তারা ধর্ম ব্যবসায়ীদের প্রভাবে না পড়ে।
ধর্ম ব্যবসা ইসলামকে অপমানিত করে এবং মুসলিম উম্মাহর জন্য ক্ষতিকর। যাদের উদ্দেশ্য আল্লাহর জন্য নয়, বরং নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করা, তাদের কাজকে ইসলাম কখনো সমর্থন করে না। সঠিক পথে চলতে এবং ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করতে, আমাদের অবশ্যই ধর্ম ব্যবসায়ীদের থেকে দূরে থাকতে হবে এবং হক্কানী আলেমদের অনুসরণ করতে হবে।
তাবলীগের কাজ ইসলামের অন্যতম পবিত্র দায়িত্ব। এটি কেবলমাত্র সঠিক নেতৃত্বে এবং সঠিক পদ্ধতিতে করলে দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা অর্জন করা সম্ভব। হক্কানী আলেমদের অনুসরণ করে তাবলীগের কাজ করা আবশ্যক। অন্যদিকে, স্বার্থবাদী আলেমদের থেকে দূরে থাকা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা রক্ষা করার জন্য জরুরি।
তাবলীগের কাজের মাধ্যমে যদি আমরা আমাদের আত্মাকে শুদ্ধ করতে পারি এবং সমাজে ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠা করতে পারি, তবে তা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক পথ দেখান এবং হক্কানী আলেমদের অনুসরণ করার তাওফিক দিন। আমিন।