ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। সংগত কারণেই হয়তো ইলিশ মাছ খাওয়ার আগ্রহ একটু বেশি। আর স্বাদে গুণে অনন্য বলেই তো ইলিশ জাতীয় মাছ। আমাদের জাতীয় আমরা খাবো, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই সৌভাগ্য সবার হয়ে উঠে না। নিম্ন-মধ্যবিত্তের এক কেজি ইলিশের দামে কমবেশি পুরো ১ মাসের অন্যান্য তরকারি খরচে ব্যয় করা যাবে।
অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা ফরিদা আখতার ভারতে ইলিশ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেেছে সরকার। দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতে ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মাহমুদুল হাসান। সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আমদানি-রপ্তানির কার্যালয়ের প্রধান নিয়ন্ত্রককে এই নোটিশ পাঠান।
আইনজীবী। নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে তিন দিনের মধ্যে রপ্তানির সিদ্ধান্ত বাতিল না করলে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করা হবে।
বাংলাদেশের রপ্তানি নীতি অনুযায়ী ইলিশ মাছ মুক্তভাবে রপ্তানিযোগ্য কোনো মাছ নয়। এ অবস্থায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভারতে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থবিরোধী কাজ করেছে।
ইলিশ রপ্তানির বিষয়ে অর্থ ও বানিজ্য উপদেষ্টা জানিয়েছেন, সরকারের সর্বোচ্চ মহলের সিদ্ধান্তেই ভারতে ইলিশ রপ্তানি করা হচ্ছে। অর্থ ও বানিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, যে পরিমাণ ইলিশ রপ্তানি হয়েছে, তা চাঁদপুর ঘাটের এক দিনের ইলিশও না। যারা রপ্তানির বিপক্ষে বলে, তারা ইমোশনাল। এ সময় তিনি ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে বলেন, ইলিশ রপ্তানিতে বাণিজ্যিক সুবিধা আছে। ফরেন কারেন্সি আসে। তাছাড়া রপ্তানি না করলে চোরাচালান হয়। আর ভারতে ইলিশ রপ্তানিতে বাহবা পেয়েছি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, অক্টোবর মাসে বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতে ৩ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
অন্যদিকে মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন,দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতের বিশেষ অনুরোধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে। এতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কিছু করার নেই। সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে উপদেষ্টা জানান, ইলিশের প্রজনন ও উৎপাদন বাড়াতে ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশ ধরা বন্ধ থাকবে।
ভারতে ইলিশ রপ্তানির বিষয়ে ফরিদা আখতার বলেন, গতকাল বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভারতে ইলিশ রফতানির অনুমতি দিয়েছে। তবে আমাদের কমিটমেন্ট আগের মতোই আছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় স্বাধীনভাবে রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে। ভারতের বিশেষ অনুরোধে বানিজ্য মন্ত্রণালয় এ অনুমোদন দিয়েছে। রপ্তানি অনুমোদনের সাথে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা বাংলাদেশের মানুষের জন্য ইলিশের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে চাই। রাজধানীর বিভিন্ন পাইকারি ও খুঁচরা বাজারে ৫০০ থেকে ৭০০ গ্রাম ওজনের ছোট ইলিশের দাম ৮০০-১২০০ টাকা কেজি, ৮০০ থেকে ১২০০ গ্রাম ওজনের মাঝারি ইলিশের দাম ) ১৫০০-১৯০০ টাকা কেজি, আর ১২০০ থেকে ২০০০ গ্রাম ওজনের বড় ইলিশের দাম ২০০০-২৫০০ টাকা কেজি।
রপ্তানির অনুমতি দেওয়ার পর ভারতে চালানের মাধ্যমে যত ইলিশ রপ্তানি হয়েছে, সেসব চালানের প্রতিটির রপ্তানিমূল্য ছিল প্রতি কেজি ১০ ডলার। বর্তমান বিনিময়মূল্য অনুযায়ী ১ হাজার ২০০ টাকা। তথ্যমতে বিগত ছয় বছর ধরে ইলিশের যত চালান রপ্তানি হয়েছে, তার ৯৫ শতাংশের রপ্তানিমূল্য ছিল প্রতি কেজি ১০ ডলার। চারিদিকে যখন ইলিশ নিয়ে এত এত আলোচনা সমালোচনা, তখন রাজশাহীতে কেটে ইলিশ মাছ বিক্রি শুরু করেছে রাজশাহীর মাছ ব্যবসায়ীরা। বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) কেটে ইলিশ মাছ বিক্রির উদ্বোধন করা হয়। যেখানে ক্রেতাগণ চাইলে এক পিস মাছও কিনতে পারবেন, আর এই এক পিস মাছের দাম আসবে ২০০ টাকা। তবে ঘোষণা অনুযায়ী এক টুকরা ইলিশ কিনতে পারেন নি ক্রেতারা। ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, টুকরা হিসেবে বিক্রি করলে ব্যবসায়ীদের লোকসান হচ্ছে। তাই ন্যূনতম ২৫০ গ্রাম বিক্রি করা হচ্ছে, যার সর্বনিম্ন দাম পড়ছে ৪০০ টাকা।
বেশি দামের কারণে অনেক গরিব মানুষের পক্ষে আস্ত ইলিশ কেনা সম্ভব হচ্ছে না। তাই রাজশাহী ব্যবসায়ী সমন্বয় পরিষদ ও ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদ বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় নগরের সাহেববাজার মাছপট্টিতে আনুষ্ঠানিকভাবে কাটা ইলিশ বিক্রির উদ্বোধন করেন।
দেখা গেছে, উদ্বোধন উপলক্ষে একটি মাছ কেটে রাখা হয়। কিন্তু সেই সময় কাটা মাছ বিক্রি হয়নি। বেলা এক’টার পর মাছপট্টিতে বড় ইলিশের দাম হাঁকা হচ্ছে ২ হাজার ৬০০ টাকা কেজি। এক মন্ত্রণালয় মাছ রপ্তানি করবে না বলে ঘোষণা দিচ্ছে, আরেক মন্ত্রণালয় রপ্তানির অনুমোদন দিচ্ছে। রপ্তানি বন্ধের জন্য আবার আদালতে রীটও হচ্ছে। শেষাবধি ইলিশ রপ্তানি হয়েই গেলো। দেশের বাজারে ইলিশের দাম আকাশচুম্বী, আর ভারতে রপ্তানি হচ্ছে দেশের বাজারের চেয়ে কম দামে।
সাধারণ জনগণের কথা চিন্তা করে কেটে পিস হিসেবে বিক্রির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করার পরে, আবার পিস হিসেবে বিক্রি বন্ধও হয়ে যাচ্ছে। এহেন কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধরা জনগণের সাথে তামাশা মনে করছেন। আমরা এমন তামাশার খেলা দেখতে চাই না, আমরা স্বল্প মূল্যে জাতীয় মাছ ইলিশ খেতে চাই। আশা করি সরকার মহল সর্বসাধারণের কথা মাথায় রেখে ইলিশ রপ্তানি না করে এবং মধ্যস্বত্ব ভোগীদের দৌরাত্ম মুছে দিয়ে জনগণকে স্বল্প মূল্যে ইলিশ খাওয়ানোর কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। আল্লাহ্ হাফেজ।
লেখক: কবি ও সাহিত্য সংগঠক
চাঁপাইনবাবগঞ্জ।