আকাশ দাশ সৈকত
অনেক দিন আগের কথা। এক অজ পাড়া গাঁয়ের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল এক অপার সৌন্দর্যের পাহাড়— তার নাম ছিল আলপা তং, যার মানে স্থানীয় ভাষায় “সুন্দর পাহাড়”।
এই পাহাড় এতটাই মনোমুগ্ধকর ছিল যে দূর দূরান্ত থেকে লোকেরা আসত তার চূড়ায় ওঠার জন্য। পাহাড়ের পাদদেশে ছিল রঙিন ফুলের বন, ঝর্ণার জলের শব্দ ছিল যেন সুরের মতো, আর সন্ধ্যার সময় পুরো পাহাড়টা লাল আলোয় জ্বলে উঠত যেন সোনা গলে পড়ছে। কিন্তু এই পাহাড়ের সৌন্দর্যের নিচে ছিল এক ভয়ংকর অভিশাপ।
লোককথা বলে, প্রতি তিন মাসে একবার পূর্ণিমার রাতে পাহাড় আপনাকে ডাকে— কিন্তু সেই ডাক শুনলে আপনি আর ফিরে আসবেন না। গাঁয়ের একজন বৃদ্ধা নানা পিও বলতেন— “যে এই পাহাড়ে চাঁদের আলোয় পা দেয়, সে আর মানুষ থাকে না।” অনেকেই বিশ্বাস করত না। তারা উঠত পাহাড়ে, গান গাইত, হাসত, খেলতো কিন্তু পরদিন সকালে তাদের নাম পাওয়া যেতো না আর কোনো খাতায়, কোনো স্মৃতিতে। এমনকি পরিবার পর্যন্ত ভুলে যেতো তারা কখনো ছিল।
একবার এক সাহসী তরুণী “মিয়াং” ঠিক করলো পাহাড়ের রহস্য উন্মোচন করবে। সে পূর্ণিমার রাতে পাহাড়ে উঠল একা। পুরো পাহাড় তখন সোনালি আলোয় মোড়া, বাতাস থমকে ছিল। সে শুনতে পেল এক মিষ্টি কণ্ঠস্বর— “তুমি কি সৌন্দর্য খুঁজছো? তাহলে চলো, আমার হৃদয়ে এসো…”সেই রাতেই সে হারিয়ে গেল।
তবে গ্রামের এক বালক “তেমু” পরে দাবি করে— সে দেখেছে মিয়াংকে। মিয়াং এর সাক্ষাতে জেনেছে তার সাথে ঘটে যাওয়া এসব কল্পকথা। তেমু এসে গ্রামবাসীকে জানায় কিন্তু সে আর মানুষ নয়। তার চোখ দুটি যেন মেঘে ঢাকা, শরীর যেন পাথরে গড়া, আর তার হাসি থেকে ঠান্ডা বাতাস বেরিয়ে আসে এবং সেই থেকেই গ্রামের মানুষের মাঝে এই মিথের প্রতি অগাধ বিশ্বাস আসে। অনেকেই বলে, আলপা তং পাহাড় আসলে একটি জীবন্ত দানব— সে তার সৌন্দর্য দিয়ে মানুষের মন কাড়ে, আর তারপর তাদের স্মৃতি, আত্মা আর শরীর গ্রাস করে আপন রূপ ধরে রাখতে।
আজও যখন পূর্ণিমা ওঠে, আর পাহাড় সোনালী আলোয় ঝিলমিল করে, গ্রামের মানুষ ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখে। কেউ উচ্চস্বরে কথা বলে না। কারণ, তারা জানে— আলপা তং ডাকছে… কিন্তু কেউ যেন শুনে না ফেলে সেই ডাক।
গল্প থেকে নেওয়া এক উপন্যাস