আমি বলছি বইমেলা ২০২৪ এর কথা---
অমর একুশে বইমেলা ২০২৪-এর অভিজ্ঞতা ছিল এক কথায় মুগ্ধকর। অমর একুশে বইমেলা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান অংশ। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে বাংলা একাডেমি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান জুড়ে অনুষ্ঠিত হয় এ বইমেলা। আর প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান জমজমাট হাজারো মানুষের কোলাহলে। এই বইমেলা কেবল বই কেনা-বেচার একটি মঞ্চ নয়, এটি বাঙালির সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের একটি বিশেষ উদযাপন। বইপ্রেমীদের ঢল, নতুন বইয়ের ঘ্রাণ, আর লেখক-পাঠকদের সরাসরি আলাপচারিতায় মেলা যেন পরিণত হয়েছিল এক সাংস্কৃতিক উৎসবে।
আমি প্রথমবার অমর একুশে বইমেলা দেখতে গিয়েছিলাম গতবছর ২০২৪ বইমেলায়। দিনটি ছিল শুক্রবার। প্রবেশ করার পরপরই নজরে পড়ল ছোট ছোট শিশুদের নিয়ে বাবা-মায়ের উচ্ছ্বাস। মেলার প্রবেশপথে বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসার চিহ্ন হিসেবে শহীদ মিনারের প্রতিরূপ দেখে মনটা ভরে উঠেছিল। বইমেলার স্টলগুলো ছিল সাজানো-গোছানো, প্রতিটি স্টলে নতুন বইয়ের পাশাপাশি ক্লাসিক সাহিত্যের বইও ছিল। জনপ্রিয় লেখকদের উপস্থিতি এবং তাদের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান মেলার একটি বিশেষ আকর্ষণ। আমার অভিজ্ঞতা শুরু হয়েছিল এক শীতল সকালে। মেলার প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম ব্যস্ত মানুষের লাইন। কিছু স্টলে থেমে দেখলাম নতুন প্রকাশিত কিছু বই। বিশেষ করে একটি স্টলে থেমে কিনলাম প্রিয় লেখকের নতুন উপন্যাস। লেখক নিজেও সেখানে উপস্থিত ছিলেন, আর তিনি অটোগ্রাফ দেওয়ার পাশাপাশি বইটি সম্পর্কে কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন। এই সরাসরি কথোপকথন আমার জন্য ছিল বিশেষ আনন্দের।
চারপাশে মানুষ জনের কোলাহল, নতুন বইয়ের গন্ধ আর সংস্কৃতিমূলক অনুষ্ঠানের মঞ্চ—সবকিছু মিলিয়ে একটি প্রাণবন্ত পরিবেশ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মেলার প্রতিটি স্টলে ছিল ভিড়। বিশেষ করে তরুণ লেখকদের বই নিয়ে পাঠকদের আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মতো। এই বছর মেলার মূল থিম ছিল "বাংলা সাহিত্য: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ," যা স্টলগুলোর সাজসজ্জা ও বই নির্বাচনে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। নতুন প্রকাশিত বই ছাড়াও এই মেলায় পাওয়া গেছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী পুঁথি, গবেষণাধর্মী বই, আর শিশুদের জন্য মনোমুগ্ধকর চিত্র বই।
মেলায় ঘুরতে ঘুরতে একটা কথা মনে হয়েছিল—বইমেলা কেবল পাঠকদের জন্য নয়, এটি লেখক, প্রকাশক এবং শিল্পীদের জন্যও একটি মিলনমেলা। সেখানে সবাই তাদের সৃষ্টিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ পান। মেলার মধ্যস্থলে বন্ধুদের সঙ্গে এক কোণে বসে কফি খেতে খেতে বইমেলার দৃশ্য দেখতে আমার খুব ভালো লেগেছিল। শিশু-কিশোরদের জন্য আলাদা স্টল এবং তাদের আনন্দমুখর চেহারা দেখে মনে হয়েছিল, বইমেলা শুধু বড়দের জন্য নয়; এটি সবার জন্য আনন্দের স্থান। মেলার আরেকটি দিক ছিল সাংস্কৃতিক আয়োজন। সন্ধ্যায় মঞ্চে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হচ্ছিল—কবিতা আবৃত্তি, গান, আর নাটকের পরিবেশনা। প্রতিদিন নতুন কিছু আয়োজন থাকায় দর্শনার্থীরা মনোযোগ দিয়ে উপভোগ করছিলেন। এই বছর বিশেষভাবে ছিল তরুণ লেখক ও কবিদের একটি আলাদা মঞ্চ, যেখানে তারা নিজেদের কাজ পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করতে পারছিলেন।
বইমেলার খাবারের স্টলগুলোতেও ছিল ব্যস্ততা। ঐতিহ্যবাহী ফুচকা থেকে শুরু করে কফি—সবই পাওয়া যাচ্ছিল। মেলার শেষে চায়ের কাপে ধোঁয়া তুলতে তুলতে বন্ধুদের সঙ্গে বই নিয়ে আলোচনা করাও ছিল এক অমূল্য স্মৃতি। অমর একুশে বইমেলা ২০২৪ শুধু বই কেনার জায়গা নয়; এটি ছিল স্মৃতির ভাণ্ডার। নতুন বই, মানুষের গল্প, আর সাংস্কৃতিক পরিবেশনা মিলিয়ে এটি হয়ে উঠেছিল এক অনন্য অভিজ্ঞতা। অমর একুশে বইমেলা থেকে কেনা আমার প্রথম বই ছিল সেলিনা হোসেনের "পোকা মাকড়ের ঘরবসতি"। বইটি হাতে নিয়ে বাসায় ফেরার সময় মনে হয়েছিল, আমি শুধু একটা বই কিনিনি; আমি ভাষা আন্দোলনের চেতনা এবং বইমেলার উষ্ণ অভিজ্ঞতার একটি অংশ নিয়ে এসেছি।
এটি এমন একটি স্মৃতি যা আজও আমার মনে গেঁথে আছে। অমর একুশে বইমেলা আমাকে শুধু বইয়ের প্রতি ভালোবাসা নয়, আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা করতে শিখিয়েছে।
---লেখিকাঃ মোছাঃ সাথী খাতুন
বগুড়া সদর, বগুড়া।
Website: www.ichchashakti.com E-mail: ichchashaktipublication@gmail.com