আদরের গরু সোনামিয়া
মাসুদ রানা
ইরাক,প্রবাসী
সোনা মিয়া—একটা নাম, কিন্তু গ্রামে এই নামটা শুনলেই সবাই জানে সেটা একজন মানুষের নয়, বরং আবু মিয়ার আদরের গরুটার নাম। আবু মিয়া একজন সাধারণ কৃষক, দিন কাটে হালচাষে আর গরুর দেখাশোনায়। তার সংসারে স্ত্রী রোকসানা, এক ছেলে জামাল আর সেই আদরের গরু, সোনামিয়া।
সোনামিয়ার সাথে আবু মিয়ার সম্পর্কটা যেন বাবার সঙ্গে সন্তানের মতো। তিন বছর আগে যখন মাত্র একদিন বয়সে গরুটাকে হাট থেকে কিনে আনেন, তখন থেকেই শুরু হয় তাদের বন্ধন। ছোট্ট সেই গরুটাকে নিজের হাতে দুধ খাইয়ে বড় করেছেন। প্রতি সকালে উঠেই আবু মিয়া আগে সোনামিয়ার কাছে যান। গরুটা ডাক দিলেই ছুটে আসে, মাথা ঘষে মালিকের গায়ে।
গ্রামে সবাই জানে সোনামিয়া কতটা বুদ্ধিমান। মাঠে গেলে একা একাই ঘাস খায়, কিন্তু ডাক দিলেই ফিরে আসে। জামাল যখন স্কুলে যেত, সোনামিয়া প্রায়ই তার পেছনে পেছনে রাস্তা পর্যন্ত যেত, তারপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকত যতক্ষণ না জামাল চোখের আড়াল হয়।
কিন্তু এবছর কোরবানির ঈদ আসছে। গ্রামের মানুষজন ইতোমধ্যে হাটে গরু তুলছে, বিক্রির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আবু মিয়ার পরিবারে টানাটানি। বৃষ্টির অভাবে ধান ভালো হয়নি, ধারদেনাও হয়েছে কিছুটা। রোকসানা প্রায়ই বলেন, “এইবার যদি সোনামিয়ারে বিক্রি না করো, কোরবানির খরচ, স্কুলের বেতন, কিচ্ছু সামলানো যাবে না।”
আবু মিয়া চুপচাপ থাকেন। রাত জেগে গরুটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, “তোকে কি করে বিক্রি করি রে সোনা! তো ত আমার ছেলের মতোই।”
তবুও বাস্তব বড় নির্মম। শেষমেশ একদিন সিদ্ধান্ত হয়—সোনামিয়াকে হাটে নিয়ে যাওয়া হবে। আগের রাতটা যেন বিষাদময় হয়ে যায় পুরো বাড়ির জন্য। জামাল খেতে চায় না, মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। সোনামিয়া যেন বুঝে গেছে কিছু একটা হতে চলেছে। সারা রাত গোয়ালে দাঁড়িয়ে চুপচাপ ছিল, কখনো চোখে জলও দেখা গেছে—আবু মিয়া ভাবে, "এমনটা কি সত্যিই হয়?"
হাটের দিন সকালে জামাল কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আব্বা, সোনামিয়ারে দয়া করে দিও না।”
আবু মিয়া মুখ ঘুরিয়ে নেয়, চোখে পানি ধরে রাখতে পারেন না। কিন্তু পরিবারের ভরণপোষণ তো করতে হবে, এই কথাটাই তাকে বাধ্য করে গরুর দড়ি হাতে তুলতে।
হাটে গিয়ে আবু মিয়া গরু তুলে দেন। সোনামিয়ার গায়ে তেল মাখিয়ে, সাজিয়ে তোলে। ক্রেতারা আসে, দাম জিজ্ঞেস করে। কেউ বলে ৭০ হাজার, কেউ ৮০ হাজার। একজন শহরের ব্যবসায়ী এসে বলে, “এই গরুটা আমি এক লক্ষে নেব।”
আবু মিয়া চুপ থাকেন। সোনামিয়া তখন তার দিকে তাকিয়ে থাকে কষ্টের চোখে।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে জামাল বলল, “আব্বা, দিও না! আমি টিউশনি করবো, স্কুলে কম খরচ করবো। তবুও তুমি সোনামিয়ারে দিয়ো না।”
আবু মিয়া বুক চেপে ধরে। হাটের ভিড়ে তিনি বসে পড়েন। মন বলে—“বিক্রি করো, সংসার চলবে।” আর হৃদয় বলে—“না, এটা সন্তানের মতো। ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছো, এটা কি হাটে তোলা যায়?”
হঠাৎ, এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। সোনামিয়া এক ঝটকায় দড়ি ছিঁড়ে ছুটে আসে আবু মিয়ার দিকে। জড়িয়ে পড়ে তার গায়ে। আবু মিয়া কান্না চেপে রাখতে পারেন না। লোকজন তাকিয়ে থাকে, কেউ কেউ ভিডিও করে। এক বয়স্ক লোক বলেন, “এই গরু আর গরু নাই, এটা তো আপনার পরিবারের সদস্য। এটা বেঁচে গেলে আপনি মানুষ থাকতে পারবেন না।”
শেষমেশ, আবু মিয়া সিদ্ধান্ত নেন—সোনামিয়াকে বিক্রি করবেন না। দড়ি হাতে নিয়ে ফিরে যান গ্রামে। হাটের লোকজন বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে, কেউ কেউ করতালিও দেয়।
গ্রামে ফিরে আসার পর জামাল দৌড়ে আসে সোনামিয়ার কাছে। গলা জড়িয়ে ধরে, কাঁদে—“তুই আমার ভাই রে!”
সেই রাতটা যেন এক উৎসবের রাত। সোনামিয়া খায় খই, মিষ্টি, আর গোয়ালঘরে তার জন্য বিছানো হয় নতুন খড়।
গ্রামের মানুষরা পরের দিন বলাবলি করে—“সত্যিই, গরু আর মানুষ মাঝে মাঝে এক হয়ে যায়। শুধু ভাষার তফাৎ, ভালোবাসার কোনো কমতি নাই।”
Website: www.ichchashakti.com E-mail: ichchashaktipublication@gmail.com