সাজিদ হাসান ছিল বুড়িগঙ্গার তীরে ছোট্ট এক শহরের শান্তিপূর্ণ আবাসিক এলাকায় বসবাসকারী এক মেধাবী তরুণ। সে স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের ছাত্র। দিনের বেলায় পড়ালেখায় মনোযোগী, আর সন্ধ্যায় দুধসাদা সাদা কাগজে অঙ্কের সমাধান লিখে হতাশার চাদর ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করত টিউটরিং-এর মাধ্যমে।
তার জীবন একটা বাঁকা রাস্তায় চলছিল, যেখানে কেউ ছিল না তার সঙ্গে কথা বলার মতো। কিন্তু সে নিজেই তার দুঃখকে গায়ে লাগাতো না, কারণ তার মনেপ্রাণে একজন ছিল—ফারহানা।
ফারহানা, সেই মেয়েটি যার চোখে নীলাভ আকাশের মতো গভীরতা ছিল, কিন্তু তার হাসিটা ছিল জাদুর মতো মায়াবী। সে ভীষণ রহস্যময়। কখনো কখনো সাজিদের টিউশনে এসে কয়েক ঘণ্টা শুধু জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকতো, যেন কোনও অনন্ত অপেক্ষায়।
একদিন ফারহানা হঠাৎ সাজিদের মুখোমুখি হয়ে বলল,
“আমি শুধু ফুল ভালোবাসি।”
সাজিদ তখন বুঝতে পারেনি সে কথার আড়ালে লুকিয়ে থাকা বিষাদের গভীরতা। সে শুধু মুচকি হাসল আর বলল,
“কেন, মানুষগুলো ভালো লাগে না?”
ফারহানা চুপ করে গেল। যেন সে আরও গভীরে ঢুকে গেল।
“মানুষেরা কথা বলে, কষ্ট দেয়, মিথ্যা বলে… কিন্তু ফুল… ফুল তো শুধু গন্ধ ছড়ায়, শান্তি দেয়,” সে বলেছিল।
সাজিদের মনে হয়েছিল, সে প্রথমবারের মতো কারও মুখ থেকে একেকটি শব্দে জীবনের অর্থ শুনেছে।
কিন্তু সেই অর্থের মাঝেই লুকিয়ে ছিল কাঁটার গোপন বারণ।
—
দিন গড়িয়েছে, সাজিদের মনে ধীরে ধীরে গাঢ় হয়ে উঠল ফারহানার জন্য এক অদ্ভুত টান। সে টিউশনের ফাঁকে ফাঁকে ভাবত, কিভাবে ওর নীরব ভালোবাসাকে প্রকাশ করবো? কিন্তু বলার সাহস হয় না। ফারহানা সে রকম কোনো কথা শোনেনি কখনো।
তারপর একদিন ফারহানার বিয়ে ঠিক হলো। প্রবাসী শাকিব, যার জীবন ছিল ধনী, ঝকঝকে এবং বর্ণিল। সে খুব কমই ঢাকায় আসতো। সব কিছুই সাজানো, পরিকল্পিত।
সাজিদকে এই খবর বুঝিয়ে দিলো তার নিস্তব্ধ হৃদয়ের গহ্বর—সব কিছু শেষ হয়ে গেছে।
—
বিয়ের পর, সাজিদ নিজের মন আর শরীরকে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করল। কিন্তু ভালোবাসা ভেঙে যায় না। সেটা হয়তো বিষ হয়ে ফিরে আসে।
সেই বিষই সাজিদের মধ্যে জমতে থাকল।
একদিন শাকিব কাতারে মারা গেল। অফিসের বিল্ডিং থেকে পড়ে। পুলিশ বলল দুর্ঘটনা, কিন্তু সাজিদ জানত—এটা পরিকল্পিত খুন।
শাকিবের মৃত্যুর খবরে ফারহানা ভেঙে পড়ল। কিন্তু কেউ জানতে পারেনি ওর মনের কথা।
সেই রাত থেকে, ফারহানার জীবন জড়িয়ে গেল এক অদ্ভুত রহস্যে।
—
প্রতিদিন ফারহানা পেত ফুল। বালিশের নিচে, অফিসের টেবিলে, ড্রয়ারে।
শিউলি, গন্ধরাজ, বেলি, গোলাপ — প্রতিটি ফুল তার প্রিয়। কিন্তু এসব ফুলের সঙ্গে থাকত একেকটি অদ্ভুত চিঠি।
চিঠিগুলোতে লেখা ছিল,
“আমি তোমার ভালোবাসা হয়ে এসেছি।
তুমি তো শুধু ফুল ভালোবাসো।”
ফারহানা প্রথমে এসবকে মজা মনে করত। কিন্তু যখন ঘর থেকে রাতের অন্ধকারে অদ্ভুত শব্দ শোনা গেল, তখন সে ভয়ে কেঁপে উঠল।
এক রাতে সে আয়নায় দেখে, তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কেউ।
কেউ যার চোখ নেই, মুখ নেই, হাতে একটি লাল জবা ফুলের তোড়া।
ফারহানা কেঁদে ফেলল। সে বুঝল, এটি সাজিদের আত্মা—ফুলের আড়ালে ফিরে আসা এক অভিশপ্ত আত্মা।
—
রাজীব এসআই তখন এই ঘটনায় তদন্ত শুরু করল।
সে খুঁজতে লাগল সাজিদের অতীত, ফারহানার বিয়ের পেছনের গল্প, শাকিবের মৃত্যুর কারণ।
সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণে রাজীব পায় অদ্ভুত দৃশ্য।
রাত ৩টা ০৩ মিনিটে একটি ছায়ামূর্তি দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকেছে, অথচ দরজার তালা ভেতর থেকে শক্তভাবে বন্ধ ছিল।
সেই ছায়াটি ছিল মুখ ও চোখবিহীন, হাতে লাল জবা ফুলের তোড়া।
রাজীব নিজেও সেই অভিশপ্ত ঘরে গিয়ে ভয় পায়। সে চিৎকার করে বেরিয়ে আসে, বলে,
“তুমি কি ফুল ভালোবাসো?”
—
রাজীব জানতে পারে সাজিদ আর শাকিবের মৃত্যুর পেছনে অনেক বড় ষড়যন্ত্র ছিল।
শাকিব না শুধু ব্যবসায়ীর, তার হাতে ছিল অন্ধকার কৃত্য। সাজিদের সাথে তার দ্বন্দ্ব ছিল।
সাজিদ নাকি শাকিবকে হত্যা করে নিজেকে ফাঁসানোর জন্য একটা পরিকল্পনা করেছিল।
রাজীব সেই গোপন কাহিনী উন্মোচন করে, যেখানে ভালোবাসা আর ঘৃণা একসঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল।
—
ফারহানার মৃত্যু ছিল সাজিদের ভালোবাসার অভিশাপের শিকার হওয়া—যে ভালোবাসা মানুষের ভালোবাসার বাইরে, ফুলের মতো অমর, কিন্তু ভয়ানক।
—
আরও অনেক গভীর অন্ধকার রাত্রি ও ফুলের গন্ধের মাঝে রাজীবের মনে হয়েছিল, এই ভালোবাসা আর শেষ নয়।
ফুলের গন্ধের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক চিরন্তন অভিশাপ—যা কখনো মরে না, শুধু ধীরে ধীরে বাড়ে।
—
শেষ হয় না এই গল্প।
যখন কেউ গভীর রাতে বলে,
“আমি শুধু ফুল ভালোবাসি,”
তখন বুঝবে, কেউ তোমার বালিশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে—
চোখশূন্য, মুখশূন্য, হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে।