রাইয়্যান ইসলাম রকিব
ভাংবাড়ী বগুড়া পাড়ার বিকেল মানেই ছিল বিশৃঙ্খলা। রাস্তার দু’পাশে দলবেঁধে ছেলেরা বসত— কেউ তাস খেলছে, কেউ চা-সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে, আর হেসে হেসে পথচলতি মেয়েদের উদ্দেশে অশ্লীল কথা ছুঁড়ে দিচ্ছে। বড়রা দূর থেকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বলত— “এই ছেলেগুলা একদিন বড় বিপদে ফেলবে।”
স্কুলের পিছনে গাছের ছায়ায় বসে চলত গোপন নেশার আসর। কিশোরদের চোখ লাল, মুখ ফ্যাকাশে—কেউ বইয়ের পাতার গন্ধ চিনত না, চিনত শুধু সস্তা গুঁড়ো আর ধোঁয়া। এলাকার মেয়েরা বিকেলে বাড়ি ফিরতে ভয় পেত।
একদিন গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেব, স্কুলের প্রধান শিক্ষক, আর কয়েকজন প্রবীণ লোক মিলে আলোচনায় বসলেন। শিক্ষক বললেন— “এভাবে চলতে থাকলে পাঁচ বছরের মধ্যে পুরো প্রজন্ম শেষ হয়ে যাবে।” সবাই একটা পরিবর্তন চাইছিল, কিন্তু উপায় পাচ্ছিল না।
ঠিক তখনই ইএসডিওর উদ্যোগে গড়ে উঠল— “ভাংবাড়ী বগুড়া পাড়া কিশোর-কিশোরী ও যুব ক্লাব”।
প্রথম দিন ক্লাবঘরে এল এক ট্রাক খেলাধুলার সামগ্রী—ফুটবল, ভলিবল, ক্রিকেট ব্যাট-বল, ব্যাডমিন্টন, দাবা, লুডু।
গ্রামের ছেলেরা অবাক! “এত কিছু! আমাদের জন্য?” ক্লাবের সভাপতি হাবিনা আপা হাসিমুখে বললেন— “হ্যাঁ, তবে নিয়ম মেনে, মারামারি-গালাগালি ছাড়া।”
খেলাধুলার সঙ্গে সঙ্গে এল এক বড় কাঠের আলমারি ভর্তি বই। গল্প, উপন্যাস, জীবনী, ইতিহাস—সব কিছু আছে। শুরুতে কেউ বইয়ের দিকে ফিরেও তাকাল না। সবার চোখ তখন ফুটবল আর ক্রিকেটে।
শিশু সুরক্ষা কমিটির সভাপতি রকিব ঠিক করল—বই পড়ার নেশা ধরিয়ে দিতেই হবে। সে একদিন মাঠের পাশে ক্রিকেট খেলা থামিয়ে বলল— “শোনো, তোমাদের এক গল্প বলি— কিভাবে এক গরিব ছেলে শুধু বই পড়ে দেশের বড় বিজ্ঞানী হলো…”
গল্পটা এমনভাবে বলল, যেন শুনতে শুনতে সবাই খেলার ব্যাট মাটিতে রেখে এগিয়ে এল। পরদিন সে বলল— “যে এই বইটা পড়বে, সে জানবে ওই বিজ্ঞানীর জীবনের আসল রহস্য।” এভাবে রকিব বইকে রহস্য আর চ্যালেঞ্জে পরিণত করল। সে আরও ঘোষণা দিল— “মাসে যার বই পড়া বেশি হবে, তাকে ক্লাবের ‘গোল্ডেন রিডার’ পুরস্কার দেওয়া হবে।”
এক মাসের মধ্যেই অবস্থা পাল্টে গেল। যে নাসির আগে নেশার আড্ডায় বসত, সে এখন ইতিহাসের বই পড়ে বন্ধুদের যুদ্ধের গল্প শোনায়।
যে নান্টু মেয়েদের বিরক্ত করত, সে এখন কবিতা লিখে সেই মেয়েদেরই পড়ে শোনায়—শালীনভাবে, শ্রদ্ধা নিয়ে। রাস্তার দুই পাশের আড্ডা ভাঙল, নেশাখোরদের জায়গা নিল দাবা খেলার বোর্ড।
এক সন্ধ্যায় জরিনা বেগম হাসিমুখে বললেন— “আমার ছেলে আগে সন্ধ্যা নামলেই গা ঢাকা দিত, এখন দেখি হাতে বই, চোখে আলো।”
মফিজ উদ্দিন মুচকি হেসে বললেন— “আগে রাস্তা পার হতে ভয় লাগত মেয়েকে নিয়ে, এখন দেখি এই ছেলেরাই রাস্তা খালি করে দেয় সম্মানের জন্য।”
আজ ভাংবাড়ী বগুড়া পাড়ায় সন্ধ্যা মানেই শান্তি। ক্লাবঘরে হাসি, বইয়ের পাতার শব্দ, দাবা খেলার চিন্তামগ্ন নীরবতা।ফুটবল মাঠে ঘামের গন্ধে মিশে আছে বন্ধুত্বের উষ্ণতা।
এলাকার মানুষ বলে— “যে ছেলেরা ছিল আমাদের দুঃস্বপ্ন, তারা এখন আমাদের গর্ব।”
গ্রামের প্রবেশদ্বারে বড় বোর্ড ঝুলছে— “ভাংবাড়ী বগুড়া পাড়া: খেলাধুলা ও বইপড়ার গ্রাম”
এখন আর কেউ এড়িয়ে যায় না এই গ্রাম। বরং পাশের গ্রামগুলো এসে শিখে—কিভাবে ইএসডিওর সহযোগিতা আর ক্লাবের উদ্যোগে একটি এলাকা অন্ধকার থেকে আলোয় ফিরতে পারে।
এক সন্ধ্যায় রকিব চুপচাপ ক্লাবঘরে দাঁড়িয়ে বই পড়া শিশুদের দেখছিল। তার চোখে জল।
সে মনে মনে বলল— “যতদিন বাঁচব, এই গ্রামে আর কেউ নেশা করবে না, কেউ অন্যায় করবে না। এই ছেলেরা থাকবে স্বপ্নে, খেলায়, আর বইয়ের পাতায়।”
শেষে গ্রামের মানুষ এক বাক্যে বলে— “ইএসডিওর কল্যাণে ভাংবাড়ী বগুড়া পাড়া কিশোর-কিশোরী ও যুব ক্লাব শুধু একটি ক্লাব নয়—এটি আমাদের নতুন জীবনের শুরু।”