আমাদের দাদা ছিলেন আজন্ম ক্রীতদাস। বাবা ছিলো যমুনাপাড়ের সুদক্ষ মাঝি। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা যাকে বিয়ে করেছিলো, তাকে আমি কোনোদিন মা বলে ডাকিনি। শুনেছি আমার বয়স যখন সবেমাত্র তিন, তখন মায়ের মৃত্যু হয়। এখনো মায়ের শূন্যতা বুকের ভিতর কুরে কুরে খায় আসুরিক ঘুণপোকা। রাতের আঁধারে অসীম আকাশের পানে তাকিয়ে লক্ষ-কোটি তারার মাঝে নিভু নিভু আলোয় আজো মাকে খুঁজে ফিরি। দিবস থেকে রাতের প্রতিটি মুহূর্তে মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ে ! কিছুতেই ভুলতে পারিনা মায়ের কথা। ভুলতে পারিনা মায়ের আদর। বাবার সংসারে সৎ মায়ের ধৃষ্টতায় কোনোদিন চোখ তুলে তাকাতে পারিনি। উগ্র শাসন আর নিষ্ঠুর আচরণে কখনো কখনো ভয়ে নিংড়ে গেছি। বাবার চোখের সামনে সৎমায়ের অমানসিক অত্যাচার বেয়নেটের আঘাতে বিদ্ধ করে মানবিক বোধ। তবুও বাবাকে কোনোদিন প্রতিবাদী হতে দেখিনি। তখন মনে হতো ‘জন্ম আমার আজন্ম পাপ’ ! পৃথিবীতে যার বেঁচে থাকার কোনো মূল্য নেই। আদর,স্নেহ, মায়া-মমতাহীন একটা জীবন কখনোই পরিপূর্ণতা পেতে পারেনা।
মানুষের প্রতি মানুষ এতোটা অমানবিক হতে পারে, এতোটা বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে, তা আমার কখনোই বোধগম্য হয়নি। একটু ভালোবাসা আর একটু আদর যত্ন পেলে আমিও একদিন মানুষের মতো মানুষ হতে পারতাম। পারতাম সূর্যের কিরণের ন্যায় আলো ছড়িয়ে আমার ভিতর-বাহির আলোকিত করতে। আমার স্বপ্নের পথে যেজন বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো, তাকে আমি কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবো না। পারবো না জন্মদাত্রী মায়ের মতো তাকে মা বলে ডাকতে। এমনো দিন গেছে দিনান্তে একবার খাবার খেতে গেলে অকথ্য ভাষায় তিনি ক্রমাগত বকে গেছেন। সবকিছু সহ্য করা গেলেও তিনি যখন আমার মৃত মায়ের উদ্দেশ্যে কথা বলতেন, তখন আমার আদৌ তা সহ্য হতো না। মনে হতো কুখ্যাত খুনীর মতো তাকে আমি খুন করে ফেলি।প্রচণ্ড সহ্যের সীমা যখন তিনি ছাড়িয়ে যেতেন, তখন আমার দুর্বোধ্য হতে ইচ্ছে করতো। ইচ্ছে করতো ভবঘুরে একটা জীবন নিজের হাতে শেষ করে দেই। আবার পরোক্ষণেই মনে হতো- এ জন্ম আমার পরম পাওয়া বিশ্ব বিধাতার কাছ থেকে। তাই আমি চাইলেও পারিনা নিজের হাতে নিজেকে শেষ করে দিতে। পৃথিবী ক্ষণস্থায়ী হলেও বেঁচে থাকার মাঝে অনেক আনন্দ আছে। বিধাতা খুব সুন্দর করে পৃথিবীটা সৃষ্টি করেছেন। সমস্ত কিছুর দায়িত্ব তিনিই পালন করছেন। নিজেই রিজিকের দায়িত্ব নিয়েছেন সমস্ত প্রাণিকুলের। তাঁর মহত্ত্বের কথা বলে শেষ করা যাবে না।
তাঁর অনুগ্রহ ব্যতীত প্রাণিকুলের কোনো উপায়ন্তর নেই। তিনি আহার দিলেই খেতে পারে সকল প্রাণী। তিনি অনন্ত অসীম। তাইতো পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী তাঁর দিকেই ধাবমান। একটা সময় তাঁর কাছেই আমাদের ফিরে যেতে হয়। তাকে ফাঁকি দেওয়ার মতো কোনো সুযোগ নেই। মানুষ যতো যাই কিছু করুক না কেন সবকিছুই তিনি স্বচক্ষে অবলোকন করেন। তবুও অধিকাংশ মানুষ তাঁকে ভুলে নিজের মতো চলতে ফিরতে অভ্যস্ত।ক্ষণিকের মোহে তাঁকে ভুলে যেতেও কোনো সময় লাগে না তাদের। তিনি চাইলে মুহূর্তেই সবকিছু নিঃশেষ করে দিতে পারেন। কিন্তু তিনি তা দেন না। ধৈর্যধারণ করেন। ভালো হওয়ার সুযোগ দান করেন। ভুলের প্রায়শ্চিত্তে ক্ষমা চাইলে তিনি হাসি মুখে ক্ষমা করেন। কাউকে তিনি ঘৃণার চোখে দেখেন না। কারো প্রতি কোনো অবিচার করেন না। তাঁর কাছে সবাই তাঁর একান্ত প্রিয় বান্দা। কেননা সবাইকে তিনিই সৃষ্টি করেছেন। অথচ এই কথাটা ভুলে যায় মানুষ। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে। বৈষম্যের শিকার হয় অধিকাংশ মানুষ। সমাজে যাদের ক্ষমতা আছে তারা ইচ্ছে মতো ব্যবহার করে পিছিয়ে পড়া মানুষদের প্রতি। তাদের মনে কোনো অনুগ্রহ নেই। আমি দেখেছি আমার সৎ মাকে। যার প্রতিটি আচরণে আমি কষ্ট পেয়েছি।যার কথায় আঘাত পেয়েছি বুকের অনেক গভীরে। কখনো প্রতিবাদ করার সাহস তো দূরের কথা, তার দিকে মুখ তুলে তাকানোর সাহস পর্যন্ত পাইনি।
এতোটাই ভয়ানক ছিলো তার আপাদমস্তক। অথচ তিনি চাইলেই পারতেন আমার সাথে ভালো ব্যবহার করতে। তার নিজ সন্তানের মতো ভালো ব্যবহার করতে। পারতেন বুকে টেনে নিয়ে মায়ের মতো লালন পালন করতে। কিন্তু সেটা তিনি কখনোই করেননি। তার সব ভালোবাসা ছিলো তার গর্ভে জন্ম নেওয়া সন্তানদের প্রতি। আমার দিকে কখনো অনুগ্রহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবদ্ধ করেননি স্নেহের বাঁধনে। যে পিতার দিকে তাকিয়ে আমার মা ভয়ে কথা বলতে পারতেন না সেই পিতা আজ থমকে গেছে দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছে । সৎ মায়ের ভয়ে তিনিও আজ কথা বলতে পারেন না। বলতে গেলে আজ তিনি দ্বিতীয় স্ত্রীর গোলাম। তার কথার বাইরে চলতে গেলেই তার বিপদ। শুনতে হয় অকথ্য ভাষার বকাঝকা। বয়সে বৃদ্ধ হয়ে গেলেও বিরাম নেই একটু বসে থাকার। পিঠের উপ রক্তজবার ক্ষত নিয়েই কাজ করতে হয় মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে। এহেন পরিস্থিতি আমাকেও খুব কষ্ট দেয়। অথচ মুখ ফুটে কিছু বলতে পারিনা। বিধাতার উপর ছেড়ে দেই। যা বলার তাঁর কাছেই বলি। যেদিন থেকে বাবা তাকে বিয়ে করে ঘরে এনেছে সেদিন থেকে আমি হাসতে ভুলে গেছি। ভুলে গেছি সুখের কথা। মা বেঁচে থাকতে কষ্ট কি জিনিস বুঝতাম না। মায়ের আদরেই বড় হচ্ছিলাম।
কিন্তু সেই সুখ আমার কপালে রইলো না। হঠাৎ একদিন মা ওপারে চলে গেলো আমাকে একা ফেলে। আমার উপর তখন কষ্টের আকাশ ভেঙে পড়লো। আমি চাইলেও আর পারিনা সেই কষ্ট থেকে নিজেকে পরিত্রাণ করতে। মুখ বুঁজেই সব সহ্য করতে হয়। এমন পরিস্থিতির মধ্যে বাবা আবার বিয়ে করে ফেললে আরো বেশি কষ্ট আমাকে চারপাশ থেকে চেপে ধরে। কিছুতেই সেই কষ্ট আর শেষ হতে চায় না। খুব ইচ্ছে ছিলো লেখাপড়া করে একদিন অনেক বড় হবো। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। পঞ্চম শ্রেণী পাশ করতেই ছাড়তে হলো লেখাপড়া। বই কলম ছেড়ে হাতে তুলে নিতে হলো জীবিকার অস্ত্র। ওইটুকু বয়সে নিতে হলো পরিবারের দায়িত্ব। শুরু হলো বাবার কাজে সাহায্য করা। শুরু হলো সংগ্রামী জীবন। আজ পর্যন্তও সেই কষ্টের হাত থেকে রেহাই পাইনি। অনবরত কাজ করেই যাচ্ছি। অথচ সুখের কোনো তরী খুঁজে পাচ্ছি না। একটু বিশ্রাম নিলেই সৎ মায়ের বকা শুনতে হয়। দেওয়া হয় ভাতের খোটা। অথচ বিপরীতে তার পেটে জন্ম নেওয়া সন্তানগুলো কতো আদরে বড় হচ্ছে। অবিচার করছে শুধু আমার উপর। আমার দিকে তার সবসময় কড়া মেজাজের আক্রোশ। মা মরে যাওয়ার পর তার হাতে যে কতো মার খেয়েছি বলে শেষ করতে পারবো না।
শরীরের অনেক স্থানে রয়েছে তার অত্যাচারের ক্ষত চিহ্ন। একটা ভুল করার সাথে সাথে তার মার খেয়েছি। কখনো বা খাবার না দিয়ে শাস্তি দিয়েছে। পেটের ক্ষুধায় মরে গেলেও তার কোনো মায়া হতো না আমার প্রতি। এভাবে কতো দিন-রাত যে না খেয়ে পার করেছি হিসেব করে বলতে পারছি না। এভাবেই কাছ থেকে দেখেছি সৎ মায়ের অত্যাচার। যার কাছ থেকে কোনোদিন একটু ভালোবাসা পাইনি। পেয়েছি শুধু দুঃখ কষ্ট। এতোকিছুর মাঝেও তাকে অসম্মান করে কোনো কথা বলিনি। সবসময় তার মাঝে আমার মায়ের ছায়া খুঁজে চলতাম। কিন্তু কখনো সেটা পাইনি। এখনো মাকে খুব মনে পড়ে। এতো বছর পরেও মাকে ভুলতে পারিনা। ভুলতে গেলে আরো বেশি মাকে মনে পড়ে। এখনো মায়ের কথা মনে হলে দু’চোখ থেকে অশ্রু ঝরে। কষ্টে ভেসে যাই সমুদ্রের নোনা জলে। কতো রাত মায়ের কথা ভেবে কেটে গেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় আমিও মায়ের কাছে চলে যাই।
এই পৃথিবীর কষ্ট আমার আর সহ্য হয় না। খুব ইচ্ছে করে মাকে মা বলে ডাকতে৷ ইচ্ছে করে মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যেতে। পৃথিবীতে মায়ের মতো আপন দ্বিতীয় কেউ নেই। যার মা নেই সেই বোঝে মায়ের শূন্যতা কতো বেশি কষ্টের। মা ছাড়া জগৎ অন্ধকার। নেই কোনো সুখের ঠিকানা৷ মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমানোর মতো সুখ পৃথিবীতে দ্বিতীয় আর কিছুতে নেই। মায়ের কোনো তুলনা হয় না৷ মা হচ্ছে পরম নিয়ামত বিধাতা কর্তৃক। যার মা আছে তার কোনো কষ্ট নেই। পৃথিবীর সবকিছুর বিনিময় হলেও মাকে আমি আবার ফিরে পেতে চাই। আবার চাই মায়ের কোলে পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে যেতে। মা, মা, মা তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি মা ! তোমাকে ছাড়া আমি ভালো নেই। সত্যি ভালো নেই মা ! তুমি ফিরে এসো মা, তুমি ফিরে এসো। তোমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি একলা আমি ফেরারি পথের বাঁকে। তুমিহীন আমি ভীষণ কষ্টে আছি মা। কোনো সুখ নেই বেঁচে থাকার। তোমাতেই যতো সুখ, তোমাতেই যতো পরিতৃপ্তি মা।